বিশ্বের সাগর মহাসাগরে চলমান পন্যবাহী জাহাজগুলোর আয়তন এতটাই বিশাল হয় যে এদের চলার পথে সৃষ্ট ঢেউকেও স্পষ্টভাবে দেখা যায় মহাকাশের স্যাটেলাইট থেকে। কিন্তু শতকোটি টাকা খরচ করে তৈরি এমন একেকটি জাহাজ নির্দিষ্ট সময় পর আর চলার উপযোগী থাকেনা। প্রশ্ন আসতেই পারে মেয়াদ উত্তীর্ণ এসব জাহাজ তবে কোথায় যায়? অবাক করার বিষয় এসব জাহাজের সিংহভাগই আসে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের মত দেশে। জাহাজ ভাঙা শিল্পে বাংলাদেশ প্রথম স্থান দখল করে আসছে বহুবছর ধরে। ভারতের অবস্থান দ্বিতীয় থাকলেও এখন সেখানে প্রতিযোগিতা করছে পাকিস্তান ও তুরস্ক। বাংলাদেশের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ জাহাজ ভাঙা শিল্প? পাকিস্তান এখানে কতটা চাপে ফেলছে ভারতকে?
সমুদ্রগামী জাহাজগুলোর নির্মান কারখানা বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশে থাকলেও মেয়াদ উত্তীর্ণ জাহাজ ভাঙা ও পূনব্যাবহারের শিল্প বর্তমানে উন্নয়নশীল দেশেই সীমাবদ্ধ। পরিবেশগত ঝুঁকি ও চড়া শ্রমমূল্যের ফলে আমেরিকা ও ইউরোপের মত দেশগুলো এ শিল্প থেকে সরে যেতে শুরু করে। সেই শূন্যস্থানটিই দখল করে নেয় বাংলাদেশ ও ভারতের মত অঞ্চল। ১৯৬০ সালের বন্যায় একটি পুরোনো জাহাজ আটকা পড়ে চট্টগ্রামে সীতাকুণ্ড সমুদ্র উপকূলে। পাঁচ বছর আটকে থাকার পর চিটাগং স্টীল হাউজ জাহাজটিকে কিনে নেয় ও যন্ত্রাংশ আলাদা করে কাজে লাগাতে শুরু করে। মূলত তখন থেকেই বাংলাদেশে যাত্রা করে জাহাজ ভাঙা শিল্প। বর্তমানে বাংলাদেশের লোহা ও ইস্পাতের চাহিদার একটি বড় অংশের যোগান দিচ্ছে সীতাকুন্ডের এ জাহাজ ভাঙা শিল্প। প্রায় ৪০ থেকে ৫০ হাজার মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আয়ের উৎস হয়ে দাড়িয়েছে বাংলাদেশের জাহাজ ভাঙা শিল্প। বহুদিন ধরে জাহাজ ভাঙা শিল্পে ভারত শীর্ষস্থানে থাকলেও বিগত কয়েক বছর ধরে ভারতকে টেক্কা দিতে শুরু করে বাংলাদেশ।
সম্প্রতি পাকিস্তান ও তুরস্কের মতো দেশগুলোও ছোট পরিসরে এই খাতে কাজ শুরু করে বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে। আর এতে চাপে পড়েছে বাংলাদেশ ও ভারত। তুরস্ক ও পাকিস্তানের মতো দেশগুলো ক্রমশ পরিত্যক্ত জাহাজগুলোর শেষ গন্তব্য হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। তবে বাংলাদেশে জাহাজ ভাঙার কাজ তুলনামূলক কমলেও দেশ এখনো শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্মের তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালে ভারতে ১৬৬টি জাহাজ ভাঙা হয়েছিল। ২০২৪ সালে তা কমে ১২৪-এ দাঁড়ায়। একইভাবে, বাংলাদেশে ২০২৩ সালে ১৭৩টি জাহাজ ভাঙা হলেও ২০২৪ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৩২টিতে। অন্যদিকে এ সংখ্যা বেড়েছে পাকিস্তান ও তুরস্কে৷ তুরস্কে ২০২৩ সালে ৫০টি জাহাজ ভাঙা হলেও ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৪ টিতে। পাকিস্তানের সংখ্যাও বেড়েছে, ২০২৩ সালে দেশটি মাত্র ১৫টি জাহাজ ভাঙলেও ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪টিতে।
তবে সূত্র বলছে বড় জাহাজগুলোর ডিসপ্লেসমেন্টে এখনো বাংলাদেশের উপরেই ভরসা রাখছে আন্তর্জাতিক মহল। তুলনামূলক ছোট জাহাজ ভাঙার দিকে মনোনিবেশ করছে পাকিস্তান ও তুরস্ক৷ তবে বাংলাদেশের জাহাজ ভাঙা শিল্পে মান্ধাতার আমলের পদ্ধতির আধুনিকায়নের দিকে জোর দিচ্ছেন অনেকে। পরিবেশগত হুমকির দিক কাটিয়ে উঠতে পারলে জাহাজ ভাঙা শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আরো বড় আশীর্বাদ হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা
0 মন্তব্যসমূহ