গোপনে গোপনে দাদাবাবুকে লক্ষ্য রাখছে পারমিতা । যেন দাদাবাবু বুঝতে না পারে। দেখতে দেখতে অভীক মজুমদার কেমন শুকিয়ে গেছেন এই ক'দিনে। চোখের কোণে জমেছে কালির ছোপ। চোখ দুটো কোটরাগত, চুলে যত্নএ হাত পড়ে না। মোটকথা উদভ্রান্তের মত চলাফেরা করছেন। অথচ বাইরে তা প্রকাশ করছেন না। অফিস ঠিকভাবেই চালিয়ে যাচ্ছেন। অভীক মজুমদার বোধহয় টের পেয়ে গেছেন যে পারমিতা উনাকে সব সময় লক্ষ্য করছে। তাই পারতঃপক্ষে পারমিতার মুখোমুখি হয় না। দেখতে দেখতে একটা সপ্তাহ চলে গেল। অভীক মজুমদার নিজেকে সামলাতে পারছেন না। কেমন ফুরুৎ ফুরুৎ করে দিনগুলো চলে যাচ্ছে। আর মাত্র ক'টা দিন হাতে। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নিয়েছেন। এই ক'টা দিন সুদেষ্ণার সান্নিধ্যে একটু দরকার থাকা খুবই দরকার।
আজ রোববার। অথচ দাদাবাবু অফিসে যাননি। পারমিতা এগিয়ে আসে দাদাবাবুর কাছে। প্রথমে দাদাবাবুই জিজ্ঞেস করে লেখাপড়া কেমন চলছে?
পারমিতা জবাবে বলে মোটামুটি চলছে এই বলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পারমিতা আবার বলে আজ অফিসে গেলেন না?
ছুটি নিয়ে নিয়েছি।
দিদি ক্লিনিক থেকে চলে এল অথচ এখন ছুটি নিচ্ছেন ব্যাপারটা কী?
শরীরটা তেমন ভালো যাচ্ছে না।- কিছু একটা লুকোবার প্রচেষ্টা অভীক মজুমদারের কণ্ঠে।
পারমিতার দৃষ্টিকে এড়াতে পারেন নি। পারমিতা জানতে চায় দাদাবাবু আমার মনে হচ্ছে আপনি আমার কাছে কিছু একটা লুকোবার চেষ্টা করছেন।
অভীক মজুমদারের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। পরক্ষণইে নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন না, না তোমার কাছে কী লুকাব?
দেখুন আমাকে এড়াবার চেষ্টা করবেন না। আপনি একটা কিছু লুকাবার চেষ্টা অবশ্যই করছেন।
বিশ্বাস কর, আমি তোমার কাছে কিছুই লুকাচ্ছি না।
দাদাবাবু আমি ওই রাতে সজাগ ছিলাম। আপনার কান্নাটা আমার কাছে অন্যরকম মনে হয়েছে।
অভীক মজুমদার ভীষণ রকম একটা ধাক্কা খেলেন যেন। তারপর নির্জীব হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলেন। পারমিতা তুমি তোমার রুমে গিয়ে বসো। আমি একটু পরে আসছি। তোমাকে সব খুলে বলবো।- এই বলে অভীক মজুমদার উঠে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালেন।
পারমিতার নিজের রুমে চলে আসে। অস্থিরভাবে পায়চারী করতে লাগল। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই অভীক মজুমদার চলে এলেন। পারমিতা পায়চারি থামিয়ে চেয়ার এগিয়ে দেয় অভীক মজুমদারকে। অভীক মজুমদার চেয়ারটা টেনে বসেন। পারমিতা কাছাকাছি হয়ে খাটের এক কোণে বসে।
আমি ক’দিন ধরেই ভাবছি তোমাকে সব খুলে বলব। কিন্ত বলতে সাহস পাচ্ছিলাম না। কথা বলেন অভীক মজুমদার, কিন্ত দৃষ্টি অন্যদিকে। পারমিতা দাদাবাবুর দিকে তাকায়। কোন কথা বলে না।
সব তোমাকে খুলে বলব। কিন্ত কাউকে বলো না।- অভীক মজুমদার অনুরোধ করেন।
বলার না হলে অবশ্যই গোপন রাখব।- জবাবে পারমিতা বলে।
পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করেন অভীক মজুমদার। একটা সিগারেট মুখে গুজে দিয়ে তাতে আগুন ধরান। লম্বা একখানা টান দিয়ে তারপর ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলেন- সিজার করানোর পরদিন থেকেই কিন্তু তোমার দিদির অবস্থা ক্রমশ খারাপে দিকে। সব রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষাই ডাক্তারের পরামর্শে করোনা হল। সবকিছুই ঠিক আছে। কিন্তু শেষে ব্লাডে ধরা পড়ে। কিছুক্ষণ থেমে থেমে আবার বলেন ব্লাড টেস্টে দেখা গেল তোমার দিদির ব্লাড ক্যান্সার। আমি উদভ্রান্তের মতো একের পর এক ডাক্তারের কাছে যাই এবং আরও কয়েকবার ব্লাড টেস্ট করাই। সব সময় একই রেজাল্ট আসে।
কথাগুলো শোনার পর পারমিতার সারা শরীর যেন অবশ হয়ে আসে। কথা বলার এতটুকু শক্তি শরীরে নেই। নির্বাক হয়ে বসে আছে। সারা শরীরে অসম্ভব রকমের মৃদু কম্পন শুরু হয়ে গেল। গাল বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল কোলের উপর ।
অভীক মজুমদার বলে চলেন এই অসুখের শুরু আরও অনেক আগে থেকেই । তোমার দিদি গোপন করে রেখে গেছে অথবা পাত্তা দেয় নি। এমন সময় রোগটা ধরা পড়ল যখন আর কোন কিছুই করার নেই। তবুও আমার পীড়াপীড়িতে ডাক্তার শেষ পর্যন্ত বলল চেষ্টা করলে বড়জোড় মাস দুয়েক আয়ু বাড়তে পারে কিন্তু কষ্টের মাত্রাটা এতই হবে যা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না । এবং নিয়ে যেতে হবে বিদেশে । এছাড়া কোনরকম সম্ভবনা নেই। অনর্থক দৌড়াদৌড়ি না করে যতদিন বাঁচবে ততদিন উনাকে ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখুন।শেষ দিনগুলো উনাকে শান্তিতে থাকতে দিন।তোমার দিদির প্রতি আমার ভালোবাসাটুকুই সম্বল। ভালো চিকিৎসা করিয়ে তোমার দিদিকে যে আরও কিছুদিন আগলে রাখব সে সুযোগটুকু আমার নেই। অভীক মজুমদারের কথায় অপরাবোধ ফুটে ওঠল।
পারমিতা এবার নিজেকে একটু সামলে নেয়ার চেষ্টা করল। তারপর সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গীতে পারমিতা বলে যা হওয়ার তা তো হবেই। প্রকৃতির ওপর আমাদের হাত নেই। আপনি একথা আর কাউকে বলবেন না। তাহলে কান্নাকাটি শুরু হয়ে যাবে। শেষ সময়টা দিদির অস্থিরতায় কাটবে তাহলে। তা হতে না দেয়াই ভালো। এ সময়টুকু আপনি দিদির কাছাকাছি থাকবেন সর্বক্ষন। আচ্ছা দাদাবাবু, দিদির ব্লাডটা আবার টেস্ট করালে কেমন হয়?
আমিও ভাবছি আরেকবার টেস্টটা করাই। তোমার দিদিকে আর বেশিদিন রাখতে পারব না। বড়জোড় সপ্তাহখানেক। তোমার দিদিকে একটু সময় দিও। জীবনের শেষ মুহুর্তে যেন পূর্ণতায় ভরপুর থাকে।- এই বলে অভীক মজুমদার পারমিতার দিকে তাকায়।
পারমিতা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। অভীক মজুমদার পারমিতার মাথায় হাত রেখে বলেন- এভাবে ভেঙ্গে পড়লে তো চলবে না। এখন আমাদের শক্ত হতে হবে। মাকে কিন্ত বলো না।
আর কোন কথা বলতে পারেন নি অভীক মজুমদার। দুঃখ-ভরা বুকে রুমের বাইরে বেরিয়ে আসেন। পারমিতা পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দাদাবাবুর চলে যাওয়ার পথে। আবার রক্ত পরীক্ষা করনো হল। এবার দেখানো হল দেশের সেরা ডাক্তরদের আরেকজনকে। একই বক্তব্য, রোগী জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছেন। চেষ্টা করে কোন লাভ নেই।
এই কথায় জীবনাচলের চঞ্চলতা থমকে আছে। পারমিতা কতক্ষণ পরপর দিদির সান্নিধ্যে যায়। বাচ্চাকে বুকে ধরে কষ্টের নিঃশ্বাসে কিছুক্ষণ সুখ নিতে ব্যর্থ চেষ্টা করে। বরং বাচ্ছাটিকে কোলে নিলে দুঃখ আরও কয়েকগুণ বেড়ে যায়। আর বাকিটা সময় রুমের ভেতর চুপচাপ বসে থাকে। অভীক মজুমদার রুমে চুপচাপ বসে থাকেন আর একটার পর একটা সিগারেট টানেন। সিগারেটের ধোঁয়ার কুগুলী তো নয় যেন দুঃখের কুগুলী ছড়িয়ে যাচ্ছে বিশ্বময়।
রুচিরা এবং সৈকত এখন প্রায় প্রতিদিনই বাসায় আসে। ওরাও দিদির খরবটা জানে। এসেই দিদির কাছে বসে কিছুক্ষণ। তারপর পারমিতাকে কিছুক্ষণ সান্তনা দেয়া ছাড়া আর কোন কিছুই করার থাকে না। যেদিন ওরা আসতে পারে না সেদিন ফোন করে খোঁজখবর নেয়।
*
পড়ন্ত বিকেল। দিদি বাচ্চাকে কোলে টেনে ঘুমিয়ে আছেন। দাদাবাবু রুমে নেই, অন্য কোন রুমে গেছেন। পারমিতা নিঃশ্বব্দে ঢুকে। দিদির কাছাকাছি এসে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। চোখ বন্ধ থাকা অবস্থাতেই দিদি বলেন পারমিতা বস, তোর সাথে কিছু কথা আছে। কথাগুলো বলতে দিদির খুবই কষ্ট হয়। দিদির শিয়রের কাছে পারমিতা বসে। দিদির মাথায় হাত রাখে। দিদি চোখ মেলে তাকায় । তারপর একটা হাত বাড়িয়ে দেয় পারমিতার কোলের উপর। পারমিতা দু’হাত চেপে ধরে ব্যাকুল-চিত্তে দিদির দিকে তাকিয়ে থাকে। শেষে খুব কষ্ট করে উচ্চারণ করে দিদি!
দিদির দু’চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু ফোটা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। চোখ দুটো কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে আছে। ঠোঁট জোড়া অসম্ভব রকমের শুকনো । জিহব্বা দিয়ে বারবার চেটে ভেজানোর চেষ্টা করছেন। কষ্টের নদী পেরিয়ে দিদির কণ্ঠে বেজে ওঠে পারমিতা, আমার সময় মনে হয় শেষ হয়ে এসেছে।
পারমিতা ভেতর জগৎ কেঁপে ওঠে। কিন্তু বাইরে তা প্রকাশ করেনি। শুধু দিদির হাতটা আরও জোরে চেপে ধরে থাকে।
শুকনো জিহব্বা শুকনো ঠোঁটে ঘষে দিদি আবার বলে আমার সময় খুবই কম। আমার সন্তান তোর কাছে রেখে যাচ্ছি। নিজের মত করে মানুষ করিস। মায়ের আদরের শূন্যতা যেন না বুঝে। আর তোর দাদাবাবুকে একটু দেখে রাখিস। খুুব ভালো মানুষরে। জীবনে কিছুই দিয়ে যেতে পারলাম না। অথৈ কষ্টে ফেলে স্বার্থপরের মত চলে যাচ্ছি। তোকে আমি অন্যায় আবদারে বেঁধে যেতে চাই না। যতটুকু পারিস তোর দাদাবাবুর জন্যে করিস। কোন রকম ভুল বলে থাকলে আমার ওপর রাগ করিস না।
পারমিতা নিজেকে আর সামলাতে পারে না। দিদির বুকে মাথা গুঁজে কান্নায় ভেঙে পড়ে। দিদি তুই অমন কথা বলছিস কেন? তুই ভালো হয়ে ওঠবি। তুই ভালো হয়ে ও... ঠ... বি...।- বলতে বলে পারমিতা ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।
ঘরের ভেতর পা রেখেই কান্নার শব্দ শুনতে পেয়ে অভীক মজুমদার তাকায়। পারমিতা দিদিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। পিছিয়ে নিঃশব্দে চলে এলেন।
মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। অভীক মজুমদার একটার পর একটা সিগারেট টেনেই যাচ্ছেন। আর সুদেষ্ণাহীন দিনগুলোর কথা ভাবছেন। বুকের ভেতর শুধু কষ্ট। চোখ বন্ধ করে চুপচাপ সিগারেট টেনে যাচ্ছেন। হঠাৎ সুদেষ্ণার ক্ষীণ কণ্ঠ কানে এল। অভীক মজুমদারের কাছে কণ্ঠটা অপরিচিতি মনে হল। বুকটা কেঁপে ওঠে অজানা আশঙ্কায়। সিগারেটটা এস্ট্রেতে গুজে সুদেষ্ণার কাছে এগিয়ে যায়। হাতটা নেড়ে সুদেষ্ণা স্বামীকে কাছে ডাকে। অভীক মজুমদার স্ত্রী সুদেষ্ণার পাশে শোয়। সুদেষ্ণা খুব কষ্টে নিজেকে টেনে এনে স্বামীর বুকে মাথাটা রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। দু’জনার মাঝে নিঃসীম নীরবতা। ভোর রাতে হঠাৎ করে অভীক মজুমদারের ঘুম ভেঙে যায়। বাইরে দৃষ্টি চলে যায়। আকাশ কিছুটা র্ফসা হয়ে এসেছে। মাঝে মধ্যে দু'একটা কাক কা-কা ডেকে ডেকে নতুন সকালের জানান দিচ্ছে। দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘরের ভেতর নিয়ে আসেন। হঠাৎ খেয়াল হয় সুদেষ্ণার নিঃশ্বাস কোনরকম স্পর্শ করছে না। পাথর খণ্ডরে মত ঠান্ডা হয়ে বুকের উপর পড়ে আছে। মাথাটা সরাতে গিয়েই টের পেলেন সুদেষ্ণা চলে গেছে দূর, বহুদূর! অভীব মজুমদার মাতৃহীন কন্যার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকান। বুকের ভেতরে এক সমুদ্র গর্জন। কিন্তু কাঁদতে ভুলে গেছেন। সময় যেন থমকে গেছে।
0 মন্তব্যসমূহ