সর্বশেষ

10/সর্বশেষ/ticker-posts

ভালোবাসার দ্বিতীয় প্রহর [পর্ব-০৭]



পার্থসারথি

সৈকত স্নান শেষে তোয়ালেতে মাথা মুছতে মুছতে রুমে প্রবেশ করে। রুমের ভেতর কয়েক কদম ফেলতেই হঠাৎ চোখ পড়ে পারমিতা ও রুচিরার ওপর। সৈকত আর্শ্চয হয়ে মুহূর্ত সময় থমকে দাঁড়ায়। খালি গা-টুকু তোয়ালে দিয়ে ঢেকে নেয়। তারপর কাছে এগিয়ে এসে সৈকত বলে- কী ব্যাপার রুচিদি হঠাৎ এভাবে এলেন যে? কথাগুলো রুচিরাকে বললেও পারমিতার দিকেও এক পলক তাকায়।

রুচিরা কিছুই বলে না। মিটিমিটি হাসে। রুচিরার হাসি পারমিতার মাঝেও ছড়ায়। পারমিতা এই প্রথম কোন ছেলে হলে এল। বেশ আড়ষ্টভাব জড়িয়ে  আছে ওর মাঝে। সৈকত এক ফাঁকে ভেজা লুঙ্গিটা রোদে ছড়িয়ে দিল। তারপর একটা শার্ট গায়ে জড়িয়ে চেয়ার টেনে কাছাকাছি হয়ে বসল। সৈকত তাকিয়ে আছে রুচিরার দিকে কিছু একটা শুনবার প্রত্যাশায়। রুচিরা কিছুক্ষণ রহস্য করল। সৈকত তো তাকিয়েই আছে; আঁড়াচোখে তাকাতেই পারমিতার চোরা দৃষ্টি ধরা পড়লো। পারমিতা গুটিয়ে গেল লজ্জায়।

রুচিরার দু’চোখ ঘরময় ঘুরে ঘুরে এসে বলল, তোমরা ছেলেরা এত অগোছালো থাক কেন?- এই বলে- দেয়ালের কোণায় কোণায় জমে থাকা মাকড়সার ঝুল, আলনায় পড়ে থাকা এলোমেলোভাবে জামা কাপড়ের  ওপর থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়ে আসে বিছানায় ওপর। রুচিরা আবার বলে- এসব পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রেখো। রুচিরা উঠে দাঁড়ায়, তারপর বলে পারমিতা বিছানাটা একটু গোছগাছ করে দাওতো।

রুচিরার কথায় পারমিতার চোখ-মুখ রক্তবর্ণ হয়ে গেল। পারমিতা বিছানায় হাত দিতেই সৈকত ‘না, না ’ বলে পারমিতাকে ফেরাতে যায়। রুচিরা হালকা ধমকের সুরে বলে সৈকত সরে দাঁড়াও। বিছানাটা একটু গুছিয়ে দিক।

রুচিরার কথামত সৈকত একটু সরে দাঁড়ায়। পারমিতা বিছানা গোছাতে থাকে।

রুচিরার শেষ কথাটায় অনিকের ঘুমের রেশটা কেটে যায়। অনিক ফিরে তাকায়। রুচিরার চোখ চোখ পড়ে। রুচিরাই প্রথমে কথা বলে সরি অনিক তোমার ঘুমে ডিস্টার্ব করলাম বলে। 

অনিক ঘুম জুড়ানো চোখেই উঠে বসে এবং বলে- না, না কোন অসুবিধা হয়নি। এখনই উঠতাম। কখন এসেছেন? একদমই টের পাইনি। তারপর পারমিতার দিকে তাকিয়ে অনিক বলে কেমন আছেন?

পারমিতা বলে আমি ভালো আছি। আপনার তো আর দেখাই পেলাম না।

কথা কেড়ে নিয়ে সৈকত বলে ও সারাদিন লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকে।

রুচিরা প্রসঙ্গ পাল্টে বলে অনিক আজ কি তোমার কোন কাজ আছে?

টিউটোরিয়াল পরীক্ষা আছে একটা দিদি। - এই বলে অনিক বলে সৈকত আমি নিচ থেকে একটু আসছি। আবার বের হয়ে যাস না কিন্তু?

সৈকত বলে ঠিক আছে, একটু তাড়াতাড়ি আসিস।

রুচিরা বুঝতে পেরে বলল অনিক, এখন কিছুই খাব না। বসো, কিছু আনতে হবে না।

সৈকত বলে ঠিক আছে, অল্প কিছু নিয়ে আয়।

রুচিরা না, না  করছিল কিন্তু অনিক কোন কথাই শুনল না। দরজা পেরিয়ে আড়াল হয়ে গেল।

রুচিরা  সৈকতকে ডেকে বলে ঝটপট তৈরি হয়ে নাও।

প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে সৈকত তাকায় ।

রুচিরা বলে আগে তৈরি হয়ে নাও। এখন কিছুই বলছি না।

সৈকত আলনার আড়ালে চলে যায়। পারমিতা এতক্ষণ চুপচাপ বিছানা গোছাচ্ছিল। বিছানা গোছানো শেষ করে টেবিল হাত দিল। রুচিরা বিছানায় এক কোণে বসল। টেবিলের এলোমেলো বই-খাতা সব পারমিতা গুছিয়ে তারপর চেয়ারটা টেনে বসল।

অনিক একটি পিচ্চিসহ রুমে ঢুকল। পিচ্চির হাতে বিস্কুট, কলা এবং একটা ডেনিস কৌটায় চা। চানাচুরের প্যাকেটটা অনিক টেবিলে রেখে একটা বড় সাইজের বোতল এবং দুটো গ্লাস পিচ্চিটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল ভালো করে ধুয়ে তারপর পানি নিয়ে আসবি।

পিচ্চিটা এক দৌঁড়ে বাইরে চলে যায়। সৈকত প্যান্ট-শার্ট পরে সামনে  এগিয়ে আসে। অনিককে ডেকে কাছাকাছি নিয়ে বসে। যখন সৈকত চানাচুরের প্যাকেটটায় হাত দেয় তখন অনিক  ডেনিস কৌটা থেকে চা গ্লাসে ঢেলে রুচিরা ও পারমিতার দিকে এগিয়ে দেয়। পারমিতা বলে আপনারা আগে খান, আমরা পরে খাই।

রুচিরা হাসতে হাসতে বলে আরে আমরা হলাম গেস্ট । কি বল অনিক? 

অনিক কথাটিতে বেশ মজা পেয়ে যায়। তারপর হাসিমুখেই স্পষ্ট অথচ প্রাণোজ্জল কণ্ঠে বলে  ঠিকই বলেছেন দিদি। আগে গেস্ট তারপর হোস্ট।

*

দরজার বাইরে পা বাড়িয়েই  সৈকত ঘড়িতে তাকায়। দশটা বাজে। অনিক দরজায় দাড়িঁয়ে থেকেই বলে- দিদি আবার আসবেন কিন্তু। রুচিরা ও পারমিতা একই সাথে বলে ওঠে- হ্যাঁ আসব।

কিছুক্ষণ এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরির পর ওরা একটা নাগাদ রিকশা নিয়ে সোজা নীরব হোটেলে চলে এল। নীরব হোটেলটা চাংখারপুল পেরিয়ে নাজিমউদ্দীন রোড়ে। পুরনো ঢাকায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই এখানে বেশি আসে। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন খাবারের পাশাপাশি বিভিন্ন রকম খাবারের সমাহার এবং দামেও বেশ সস্তা। ঢাকা শহরে এত সস্তায় এমন রুচিশীল খাবার পাওয়া সত্যিই দুষ্কর। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের এত ভিড়।

ভিড় থাকা সত্ত্বেও এক কোণের টেবিলে ওরা জায়গা পেয়ে গেল। চেয়ারে বসতে বসতে রুচিরা বলে- কি কি অর্ডার দেব, তোমরা বল।

সৈকত উত্তরে বলে- আজকের পুরো দিনটাই আপনার হাতে ছেড়ে দিলাম।

রুচিরা সৈকতের কথাতে বেশ খুশি হয়ে বলে- আচ্ছা ঠিক আছে, তবে তোমাদের পছন্দের বিশেষ কিছু বাদ পড়ে গেলে অবশ্যই কিন্তু বলবে।

সৈকত হাসতে হাসতে বলে আপনার কাছে যদি লুকিয়ে রাখি তাহলে কি চলবে? তারপর সৈকত বয়কে ডেকে বলে- মামু, এদিকে আসেন।

বয় যেন ডাকের অপেক্ষায় ছিল। ডাক দেবার সাথে সাথেই চলে এল।

বয় কাছে আসতেই রুচিরা অর্ডার দেয়- সব রকমের ভর্তা এবং ভাজি, শুকনা মাছের ভর্তাও বাদ যায়নি।

মাংসের কথা বলতেই সৈকত মৃদু আপত্তি তুলে বলে আজ মাছ-মাংস বাদ শুধু শাকসবজি আর ভর্তা, কি বল পারমিতা?

দিদি অর্ডার দিচ্ছেন যেহেতু আজকে অন্তত মিশালীভাবেই চলুক।

ওকে, র্অডার পাস হয়ে গেল। - এই বলে সৈকত হাসে।

কাঁটায় কাঁটায় তিনটেয় ওরা হোটেলের বাইরে এলো। হোটেল গেটের পাশের দোকান থেকে তিনজনই মিষ্টি পান খেলো। তারপর রিকশা  নিয়ে জাতীয় জাদুঘরে চলে এল। রুচিরা এর আগেও একবার এসেছে। আবার দেখার খুব ইচ্ছে হচ্ছে । সৈকত গত দু‘বছরে জাদুঘরে একবারও  উকি দেয়নি। জাদুঘর দেখেছে কিনা জিজ্ঞ্যস করতেই লজ্জায় লাল হয়।  

পারমিতা বলে ‘আমিও যাই নি। 

রুচিরা পারমিতাকে বলে ‘তুমি তো মাত্র ফার্স্ট ইয়ারে । হয়ত ক্যাম্পাসের মোহেই এখনও আবিষ্ট হয়ে আছো। সৈকতের এতদিনে আসা উচিত ছিল। কত দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন আসে জাদুঘর দেখতে। আর আমরা কাছে থেকেও খোঁজ নিই নি। এটা কিন্তু ঠিক না। আমাদরে সবসময় উচিত নিজেদের ইতিহাস এবং ঐতিহ্কে জানা। তাছাড়া এগুলো আমাদরে একদম পাশ। 

সাড়ে তিনটা নাগাদ ওরা জাদুঘরে ঢুকে সবকিছু খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে। কোনটা কোথা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে, কে ব্যবহার করত, কে মালিক ছিল। কত সালের জিনিস । মোট কথা সব সূত্রই লেখা আছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভালোভাবে দেখে নিল। সাড়ে ছয়টা নাগাদ ওরা বেরিয়ে এল জাদুঘর থেকে। তারপর রিকশা নিয়ে বেইলি রোড়, নাটকপাড়ায়।

রিকশা থেকে নেমেই সৈকত রুচিরাকে বলে রুচিদি, নাটক দেখে ফিরতে ফিরতে দশটাও বেজে যেতে পারে। আপনাদেরতো হলে ঢুকতে দেবে না।

রুচিরা উত্তরে বলে ‘অ্যাপ্লিকেশন করে পারমিশন নিয়েই এসেছি। কোন অসুবিধা হবে না।

সবকিছু তাহলে আগেই প্লান করে রেখেছিলেন?

রুচিরা মিষ্টি হেসে বলে- মোটামুটি।

নাটক শেষ হলো রাত সাড়ে নয়টায় । রুচিরা ও পারমিতাকে হলে পৌঁছে দিয়ে সৈকত হলের দিকে চলল। রিকশা চলছে বাতাসের উল্টোদিকে। ফুরফুরে বাতাস সৈকতের মনটাকে আরও সজীব করে তুলল। খোশমজোজের  আমেজের সৈকত  গানে সুর মেলাচ্ছে। আজ সত্যিই আনন্দের দিন। পারমিতাকে খুবই কাছে পেয়েছে এবং মনে হয়েছে পারমিতার খুবই কাছের জন। রিকশা কখন হল গেইট চলে এল সৈকত একদমই টের পায়নি। রিকশা থামতেই ভাবনায় যতি রেখা পড়ল।

রুমে ঢুকতেই অনিক, সুমন্ত ও আসিফ একসাথে বলে উঠল - কনগ্র্যাচুলেশন।- এই বলে সবাই হাত বাড়িয়ে এসে হাত মেলায় এবং বুকে মেলায় বুক। সৈকত চুপচাপ দাঁড়িয়ে । সে কিছুই বুঝে উঠতে পারে নি। অবাক দৃষ্টে ওদের দিকে তাকিয়ে রইল। প্রথমে আসিফ বলে ওঠে- অবাক হচ্ছো কেন বন্ধু? ডুবে ডুবে জল খেলে কী হবে? এখন ওপেন সিক্রেট। এত বড় সুখবরটা পেয়ে ভাবলাম বন্ধুটির সাথে দেখাটা করেই যাই। কি ঠিক করি নি? 

আসিফের কথায় সবাই হাসতে হাসতে সৈকতকে ধরে মাথার ওপর তুলে ফেলল। কতক্ষণ পর সৈকতকে বিছানায় পুতুলের মত ফেলে দিল। তারপর সুমন্ত সবার উদ্দেশ্যে বলে আজ রাতটা শুধু আনন্দের, আনন্দের আর আনন্দের ।- এই বলে আসফি পকেট থেকে একটা পুটলা বের করে সৈকতকে দেখায়।

সৈকত উঠে বিছানায় বসতে বসতে বলে- শুকনাটা আমি একদম সহ্য করতে পারি না।

আসিফ জোর গলায় বলে ‘আজ অন্তত ক্ষমা নেই।

আসিফের কণ্ঠে অন্যরাও কন্ঠ মেলায়। 

অনিক নিচে গিয়ে মুড়ি আর চানাচুর নিয়ে আসে। তারপর সবাই ছাদের উপর ওঠে। জোছনার আলোয় চারদিকে আলোকিত আকাশে লক্ষ তারার ঝিকমিক। চারদিক আলোকিত। সৈকতের মনটা হাওয়ায় হাওয়ায় উড়ে বেড়ায় তারকালোকিত আকাশে। গাঁজা টেনে সবাই একটু  আধটু নেশাচূড় হয়। কিন্তু সৈকত নিজেকে সামলাতে পারল না। ছাদের উপর শুয়ে পড়ল। আর দৃষ্টি মেলে দিল নীল আকাশের অসীমে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ