ডঃ গৌতম সরকার
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার কেটেছে দীর্ঘ দশ বছর (১৯৮৯- ১৯৯৯)৷ এই দশ বছরে কত কত মানুষের সংস্পর্শে এসেছি - বন্ধুবান্ধব, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, সিনিয়র দাদা-দিদি, গার্জিয়ান(বন্ধুদের ), ছাত্র ছাত্রী (টিউশন সূত্রে ) আর তাদের বাবা-মা, এছাড়া আরও কত শত মানুষ যারা এই অচেনা- অজানা শহরে আমাকে প্রতি মুহূর্তে বেঁচে থাকতে সাহায্য করেছে ; এদের সবার কাছ থেকে আমি অফুরন্ত স্নেহ, ভালোবাসা, আশকারা, গুরুত্ব, শ্রদ্ধা, বন্ধুত্ব, সাহায্য, যত্ন, জ্ঞান সবকিছু পেয়েছি৷ এই সব মানুষগুলো তাদের শিক্ষা আর কৌলিন্যে কখন যেন গ্রামের সেই ভীতু ছেলেটাকে তাদের শহরের একজন করে তুলল৷ সবার আগে অবশ্যই আসবে আমার ক্লাসমেট বন্ধুদের অবদান, যারা প্রায় সবাই কলকাতার বিখ্যাত বিখ্যাত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছাত্র -ছাত্রী ; কিন্ত তারা তাদের শিক্ষার ঔদার্যে ও মহত্বে ( স্কুল এবং অবশ্যই বাড়ির ) আমাকে এক মুহূর্তের জন্যও বুঝতে দেয়নি আমি তাদের দলের নই৷ শুধু তখনই নয়, সেটা আমি এখনও তাদের কাছ থেকে প্রতি মুহূর্তে পেয়ে থাকি আর ভিতরে ভিতরে বকবক খুশি হই৷ সবচেয়ে বড় কথা, গ্রাম থেকে উঠে আসা বাংলা মিডিয়ামের একটা ছেলের কাছে সেটা এক বড় কঠিন সময় ছিল, ওইসময় এই সব মানুষদের ঐকান্তিক সাহায্য ও ভালোবাসা না পেলে কোথায় হয়তো ভেসে যেত সেই ছেলেটা, একটু উপেক্ষা, একটু মজা বা উপহাস কি নিতে পারত পিয়াসাড়া জমিদার বাড়ির সেই গ্রাম্য ছেলেটা ! তাই আমার জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচিত হয়েছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্টস ফ্যাকাল্টির চারতলা বিল্ডিংটার ইঁটকাঠে, বিখ্যাত সেই লবির সিগারেটের ধোঁয়ায়, মিলনদার ক্যান্টিনের ঢপের চপে, গান্ধীভবনের 'বাই সাইকেল থিভস'-এ, বড়লোক কোনো বন্ধুর ঘাড় ভেঙ্গে এসি ক্যান্টিনে খাওয়া সেঁকা পাউরুটি আর চিকেন স্ট্যুতে, আর ব্যাস্ততার ভান দেখিয়ে অকারণে বন্ধুদের সাথে লেডিস হস্টেলের সামনে দিয়ে বারংবার পায়চারির মধ্যে দিয়ে৷ এই সমস্ত মানুষ, পরিবেশ, পরিজন নিভৃতে কখন যেন পিয়াসাড়া অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছেলেটাকে পরতে পরতে পালিশ করে কলকাতার উপযুক্ত করে তুলল-ছেলেটা নিজেই বুঝতে পারলো না৷
শুরুতে খুব স্বাভাবিক কারণেই আমরা যারা বাইরে থেকে এসে এখানে মাস্টার্সে ভর্তি হলাম তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গাঢ় হল -চারটি ছেলে, চারটি মেয়ে ( প্লিজ এখানে অন্য কোনো সমীকরণ করার চেষ্টা করবেন না )৷ আমি, রঞ্জন, সুব্রত আর শিবাজী আর অন্যদিকে সোনালী, অপরাজিতা, লোপামুদ্রা, আর ডেইজি ; আমরা সবাই অর্থনীতি নিয়ে পড়ি কিন্তু ডেইজি দর্শনের ছাত্রী৷ ডেইজি আমাদের বান্ধবীদের সাথে একই হোস্টেলে থাকে সেই সূত্রে আমাদেরও বন্ধু৷ আর অদ্ভূত একটা ইকুয়েশন ছিল -আমাদের দলের সব মেয়েরা ছিল ইংলিশ মিডিয়ামের আর আমরা ছেলেরা সব বাংলা মিডিয়ামের৷ কিন্তু বিশ্বাস করুন, কখনো কোনো আচরণে, কথা-বার্তায়, আলোচনায় নিজেদের এতটুকু অপাংক্তেয় বলে মনে হয়নি কারণ আমাদের বন্ধুরা ছিল প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত, তাই তারা তাদের স্বাভাবিক ঔদার্যে আমাদের অবিলম্বেই আপন করে নিয়েছিল৷ এখানে সোনালীর কথা আলাদা করে না বললে অন্যায় হবে ; ওর একটা শান্ত, স্নিগ্ধ পার্সোনালিটি ছিল যেটা গ্রুপের সবাইকে খুব আকর্ষন করত৷ আমাদের বান্ধবীরা সবাই আসানসোলের নামকরা স্কুল-কলেজের (ইংলিশ মিডিয়াম) ছাত্রী, কিন্তু তারা আমাদের মতো ছন্নছাড়া, অমার্জিত, গ্রাম্য বাংলা মিডিয়ামের ছেলেগুলোকে শুধু আপন করে নিল তাই নয় আমাদের মধ্যে এই বিশ্বাসও তৈরী করে দিল যে আমরাও ওদের সমকক্ষ৷ সেদিন হয়ত এভাবে বুঝতে পারিনি, কিন্তু আজ এই প্রৌঢ়ত্বের দরজায় দাঁড়িয়ে প্রতি মুহূর্তে বুঝতে পারি সেটা কত বেশি জরুরী ছিল৷ একদম প্রথমে কোনোভাবেই কলকাতা শহরের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারতাম না, মনে আছে শনিবার আমাদের একটামাত্র ক্লাস থাকত আর তাই আমি প্রত শুক্রবার বাড়ি চলে আসতাম আবার খুব বিরক্তির সাথে সোমবার ফিরতাম ; তারপর আস্তে আস্তে যত বন্ধুত্ব বাড়তে লাগলো বাড়ির প্রতি টান কমতে থাকলো আর ইউনিভার্সিটির টান বাড়তে লাগলো৷ বেশ কিছুদিন পর টের পেলাম আমি বাড়ি গেলে আমার বন্ধু-বান্ধবীদেরও খারাপ লাগে৷ এটা বোঝার পর এই শহরটাকে সত্যি করে ভালবেসে ফেললাম৷ আর ফেরার কোনো উপায় থাকলো না, যার ফলশ্রুতি কালক্রমে আমিও কখন যেন একজন ক্যালকেশিয়ান হয়ে উঠলাম৷
(চলবে……)
0 মন্তব্যসমূহ