সর্বশেষ

10/সর্বশেষ/ticker-posts

প্রবন্ধ- দুই বাংলার কাব্যে -গানে বসন্তের পলাশের মনোমুগ্ধ বন্দনা: ডঃসুবীর মণ্ডল

 



'পলাশের কুঁড়ি,

একরাত্রে বর্ণবহ্নি জ্বালিল সমস্ত বন জুড়ি।'

পলাশ আমাদের কাছের ফুল। বাঙালীর ফুল। ফাল্গুনের-বসন্তের ভালোবাসার ফুল। বিরহ-বিদ্রোহের প্রতীক। এই ফুলের আরো একটা নাম আছে - অরণ্যের অগ্নিশিখা।

  পলাশ , বহু প্রাচীন গাছ । শীতের কশাঘাতে যখন পাতারা ঝরে যায়, রিক্ত পলাশ গাছের কোলজুড়ে তখন আসে সহস্র রক্তিম পলাশ ফুল। তখন মনে হয়, বনে আগুন লেগেছে। নবীন পাতার সমারোহ তখন বনজুড়ে দেখে এই পলাশের বর্ণমিছিল। বাংলা সাহিত্যে পলাশের প্রভাব অতিশয়। গানে, কবিতায় কোথায় নেই পলাশ।  তবে শুধু এ কালের সাহিত্য নয়, পলাশ সুপ্রাচীনকালেও ছিল সমান আদরণীয়।

মহাভারতের সভাপর্বে ইন্দ্রপ্রস্থ নগরের যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, সেখানে উদ্যান আর কৃত্রিম জলাধারের পাশেও ছিল পলাশ বৃক্ষের মাতামাতি।

বেদ - এ উল্লেখ স্পষ্ট ।  প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যের কাল থেকে আজ পর্যন্ত  পলাশ ভাবনা যুগ ভেদে রূপ পালটেছে  প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে , এর উল্লেখ কিংশুক  নামে।
মহাকবি কালিদাসের, ' ঋতুসংহার '  ' কুমার সম্ভব 'বিভিন্ন কাব্যে  কিংশুকের অবস্থান এবং তার বর্ণনা  আজও " মিথ "।

বৈষ্ণব কাব্য ' জয়দেবের গীত গোবিন্দে  '  পলাশের  রূপ- বর্ণনায় " মদনের " পঞ্চশর  " এর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এছাড়া বসন্ত কাল , মধুমাস  ইত্যাদির সঙ্গে পলাশের নিবিড় যোগ  এবং সঙ্গে অবশ্যই প্রেম, কাম অনুষঙ্গ হিসাবে  কল্পিত হয়েছে ।

আধুনিক কাব্যে মধুসূদনের হাতে পলাশ কামগন্ধহীন  এক অতি গুরুত্বপূর্ণ  ফুলের পরিচয়ে পরিচিত।

রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তাকে আরো বেশি করে  " বাসন্তিক " সমারোহে অভিষিক্ত করলেন, প্রেম, ভালবাসা ও মিলনের প্রতীক হিসাবে । অসংখ্য গান রচনা করলেন  পলাশ অনুসঙ্গে ।
" পলাশের  প্রতি নজরুলের আবেগ , তাঁর নিজস্ব- নির্জন চিন্তার ফসল । বহু সুরেলা গান তিনি উপহার দিয়েছেন  পলাশ অনুসঙ্গে ।

নজরুলের পর বাংলা গানে যে, ভাবে " পলাশের উল্লেখ এসেছে...  তা নিয়ে তেমন করে ভাবা হয়নি । বাংলাগান বলতে আমি " স্বর্ণযুগের আধুনিক গানে' র কথা বলছি।

একটা বিরাট  সময় গেছে, যে সময় "পলাশ" নিয়ে বহু আধুনিক বাংলা গান রচিত হয়েছে । সুরের বৈচিত্র্যে প্রভুত জনপ্রিয় হয়েছে সেই সব গান।  কিন্তু  তেমন ভাবে আলাদা ক'রে ভাবা হয়নি ।

প্রথমে যে গানের কথা উল্লেখ করবো,  সেটি হ'লো ষাটের দশকের সূচনাতেই " হস্ পিটাল " সিনেমা অসাধারণ জনপ্রিয় সেই গান ---
   " এই সুন্দর স্বর্ণালি সন্ধ্যায়
        এ কি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু।
    কোন রক্তিম পলাশের স্বপ্ন
         মোর অন্তরে ছড়ালে গো বন্ধু । "
সুকন্ঠি গীতা দত্তের গাওয়া এগান আজও জনপ্রিয়তার তুঙ্গে।
গানটির রচয়িতা গৌরী প্রসন্ন মজুমদার  এবং সুর দিয়েছিলেন  অমল মুখোপাধ্যায় ।
এই গানের লোকেশান ছিল, " তোপচাঁচি লেক "। সেই সময় চার পাশে পলাশের বিস্তৃত সমারোহ ।
গানটি রচিতই হয়েছিল প্রাকৃতিক প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে.....
                 
  ' হস্ পিটাল ' সিনেমার গানে  গৌরী প্রসন্ন বাবু যে , " রক্তিম পলাশের স্বপ্ন " কথাটি উল্লেখ করেছেন,  তাতে  পলাশের চিরকালীন প্রেম-রাগের পরিচয়টিই ব্যক্ত হয়েছে ।
কিন্তু  এর কিছু আগেই গৌরী বাবু আর একখানি পলাশ  অনুষঙ্গে গান লিখে দেন " পথে হ'ল দেরি " ( ১৯৫৭)  সিনেমার জন্য । সেখানে পলাশ " আনন্দ- স্বরূপ ঐশ্বর্যে" র প্রতীক । রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে গানটি গেয়েছিলেন গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। গানটি ছিল --
  " পলাশ আর কৃষ্ণচূড়ায় আগুন জ্বেলে,  ফাগুন বেলা
                 রঙে রঙে রাঙিয়ে তুলি -
                 আমি কস্তুরি সে মৃগের মতো
                 নিজের গন্ধে নিজেই ভুলি । "

এ গান সমকালে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠেছিল । আজও সমান জনপ্রিয় ।
শুধু সিনেমা কেন , সে কালে আধুনিক বাংলা গানের সব থেকে বড় আকর্ষণ ছিল ' পুজো- সংখ্যা  ' গান।  গৌরী প্রসন্ন মজুমদার কিন্তু এখানেও পলাশ ফুল নিয়ে এলেন।

সেই প্রাচীন কাল থেকেই , কবিরা মধুমাসের প্রতীক হিসাবে পলাশ ফুলের সঙ্গে  অন্যান্য ফুলের উল্লেখ করে এসেছেন ।  কালিদাস থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কেউ বাদ যান নি।
গৌরী বাবুও সেই স্বর্ণযুগে এরকম একটা বিখ্যাত গান  লিখলেন।  নিজের সুরে গানটি গেয়েছিলেন শ্যামল মিত্র  --
       " ও শিমূলবন, দাও রাঙিয়ে মন,
       কৃষ্ণচূড়া দোপাটি আর পলাশ দিল ডাক।
            মধুর লোভে ভিড় জমালো
           মৌ- পিয়াসী অলির ঝাঁক । "

এরপর বাংলার স্বনামধন্য  গীতিকার এবং সুরকারেরা এক এক ক'রে পলাশ- অনুষঙ্গে গান উপহার দিতে থাকলেন ।
উপোরক্ত গানটি যখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ,  ঠিক তখনই শ্যামল গপ্তের  লেখা এবং শ্যামল মিত্রের সুরে , সেকালে অত্যন্ত সুমিষ্ট কন্ঠের অধিকারিনী শিল্পী গায়ত্রী বসু রেকর্ড করেন এই গানটি ...
     "   পলাশ বনতল পরেছে কেন আজ
           পুলকে ঝলমল রাঙ্গা ফুলসাজ
            ও গো মিতা , জানো কি তা..?  "

অসাধারণ গান ছিল এগুলি।  তবে এসব গান শোনার সযোগ ছিল কম। একমাত্র রেডিও। তাতে ' অনুরোধের আসর ' ও ' ছায়াছবির গান  ' -- এগুলিই ছিল শোনার ভরসা।
তবে কিছুদিনের মধ্যেই ছবিটা বদলে গেল । " সুখি গৃহকোণ, শোভে গ্রামাফোন "-- ঘরে ঘরে রেকর্ড- প্লেয়ার এলো, চেঞ্জার এলো -- গানও তৈরি হ'ল প্রচুর।
পলাশ - অনুষঙ্গের গানও বাদ গেলো না।
মঞ্চে এলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়,  সঙ্গে সেই গৌরী প্রসন্ন মজুমদা  ।  মাতিয়ে দিলেন লতা মঙ্গেস্কর  সেই গানে ----
           " ও পলাশ।, ও শিমূল
            কেন এ  মন মোর রাঙ্গালে
               জানি না, জানি না
           আমার এ ঘুম কেন ভাঙ্গালে  "।

এই গানের জনপ্রিয়তার কথা নাই বা লিখলাম ।

ক্রমশ শ্রোতার কান পলাশ অণুষঙ্গে গান শুনতে অভ্যস্ত হ'য়ে  উঠলো ।

       গৌরী প্রসন্ন মজুমদার ,  হেমন্ত মুখোপাধ্যায়  এবং লতা মঙ্গেস্কর -এই তিনজনের নিবেদনে , " ও পলাশ ,  ও শিমূল...  " গানটি  বাংলা গানের জগতে  একটা ' মাইল-স্টোন ' -- বলা যেতে পারে ।

   বাংলা গানে ' পলাশ ' এসেছে , সলিল চৌধুরী  থাকবেন না , তা হয়...?
লিখলেন  ' পলাশ ' অনুষঙ্গে একটি গান । সুর দিলেন তাতে নিজে । গাইলেন  সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ।
      " গুন গুন মন ভ্রমরা,  কোথা যাস কিসেরই ত্বরা
        কেন তোর এ ফুল , ও ফুল, সে ফুল করা।
       আকাশে রং লেগেছে, নদী দুই কূলে ভরেছে
        এসেছে দারুণ ফাগুন   আগুন ঝরা..।

        লাল লাল পলাশের বনের ডাক শুনে কি,
        দিন দিন রজনী  ছিলে,  কাল গুনে কি ?
        হায় রে তোর বকুল শিমূল পারুল মরেছে,
        নীল নীল রং পারিজাতের পাপড়ি ঝরেছে
        এবার যে তোর সময় হ'ল ঘরেতে ফেরার । "

এ গানও জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ওঠে ।
    সুকন্ঠি গীতা দত্তের গান দিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলাম , ' পলাশ ' অঙ্গের তাঁর গাওয়া এই গানটি এ্যাতো জনপ্রিয়  হয়েছিল যে, তা বলার কথা নয়।
এ গানের গীতিকার ছিলেন অনল চট্টোপাধ্যায়  আর সুরকার  কানু  রায় (  ঘোষ..?)। গানের কথা ---

        " আকাশ জুড়ে স্বপ্ন মায়া চাঁদের জোছনায়
           রামধনু ওই আবির ছড়ায় রং এর তুলিকায়
         

           আয় আয় ময়নামতির গাঁয়, আয় আয় রে,
           লাল লাল পলাশ ফুটেছে , আয় আয় রে ,
           দল দল ভোমরা জুটেছে,  আয় আয় রে,
     আকাশে আর বাতাসে, তার কানাকানি শোনা যায়। "

  জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় নিজের লেখা এবং  নিজের সুরে এই গানটি  গাইলেন..

       " কেউ বলে ফাল্গুন, কেউ বলে পলাশের মাস
                   আমি বলি আমার সর্বনাশ।
         কেউ বলে দখিনা ,  কেউ বলে মাতাল বাতাস,
                    আমি বলি , আমার দীর্ঘশ্বাস  "।

আধুনিক বাংলা গানের কথায় ' পলাশ ' যে, স্থায়িত্ব লাভ করেছে ... তাতে আর কোন সন্দেহই  রইলো না।

  ইতিমধ্যে   প্রযুক্তিগত নানা পরিবর্তনে আমাদের জীবনে অনেক কিছুই বদলে গেছে ।  রেডিওতে গান শোনার দিন হারিয়ে গেছে । হারিয়ে গেছে ' অনুরোধের আসর ' আর ' ছায়া- ছবির গান '।
তবে কি আমরা গান শুনতে পাই না..?
এই তো পুজো গেলো, পিকনিকের মরসুমও  গেলো, সামাজিক অনুষ্ঠান তো লেগেই আছে..  তার সঙ্গে মাইক বাজবে ,  অথচ আশাজীর এই গানটা বাজবে না, ভাবাই যায় না... ঝুমুর তালের সেই গান ---
        
  " মহুয়ায় জমেছে আজ মৌ গো..
     ......  মহুয়ায়...
    জানি না তো, এ কি আমার হ'ল
         দিন আর না গুনে
          পলাশের আগুনে
          লাগে রং ফাগুনে .. এ..
      তোমাকে দেখে যে আজ
      চোখে চোখ রেখে যে আজ
মনেরই ময়ূর নাচে ছৌ গো...  ও.. ও "

এ গানের কথা গৌরী প্রসন্ন মজুমদার , সুর রাহুল দেব বর্মন ।

 একটা প্রশ্ন থেকেই যায় , আমরা গান শুনতে খুব ভালবাসি । গান আমাদের সুখ দুঃখের সাথী , মানস- মুক্তির মাধ্যম ।  আমরা গায়ক / গায়িকা এবং সুরকারকে   যতখানি  মনে রাখি,  গীতিকারকে ততখানি রাখি না । ...  এটা বড় দুঃখের ? 

বৈজ্ঞানিক নাম: Butea monosperma (Lam.) Taub.

ইংরেজি নাম: Flame of the Forest, Bastard Teak, Parrot Tree, Battle of Plassey tree, Bengal kino and others.

সংস্কৃত নাম: কিংশুকা (Kimshuka), পলাশা (Palasha), ব্রহ্মবৃক্ষা (Brahmavrksha), রক্তপুষ্পকা (Raktapuspaka), বক্রপুষ্পা (Vakrapushp) and others.

পরিবার: Fabaceae

সমনাম:
Butea braamania DC.
Butea frondosa Roxb.
Erythrina monosperma Lam.
Plaso monosperma (Lam.) Kuntze
Rudolphia frondosa (Willd.) Poir:-collt 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ