সর্বশেষ

10/সর্বশেষ/ticker-posts

ধারাবাহিক উপন্যাস- ভালোবাসার দ্বিতীয় প্রহর [ পর্ব-০১]


লেখক- পার্থসারথি

 পড়ন্ত বিকেল। ছায়া ক্রমশ লম্বা হচ্ছে। রোদের প্রখরতা সরে গেছে অনেকক্ষণ। পাখিদের উড়াউড়ি আকাশের সীমানায় বেড়ে গেছে। মৃদু শান্ত হাওয়া নবপল্লবের চূড়ায় নেচে বেড়াচ্ছে মনের আনন্দে। সৈকতের মনের প্রতিচ্ছবি যেন এ পড়ন্ত বিকেল। সুদূর আকাশের গভীর নীল ওর মনের গভীরতাকে চুমু খেয়ে গেল এক পলকে। আনন্দের ঝর্ণা কল্পনার জগৎ থেকে বয়ে গেল মনের গোপন ঘরে। আজ সবকিছুতেই যেন আনন্দের আর সুখের ছড়াছড়ি। হৃদয়-ঘরের ভেতর সুখের পাখিরা কিচিরমিচির করে বেড়াচ্ছে আপন মনে। আর সৈকত সুখের গভীর অরণ্যে হারিয়ে যাচ্ছে জেনে-শুনে পথ ভুলে। সময়ের এ সন্ধিক্ষণে মনটা ভীষণ মাতাল হয়ে ওঠেছে সুখের সুরায় হাবুডুবু খেয়ে। যেদিকে তাকায় সুখ ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। জানালা গলে সৈকতের দৃষ্টি নবযৌবনা রাধাচূড়ার গায়ে পড়ল। সাথে সাথে মনটা চঞ্চলা ভ্রমররের মতো নেচে উঠল আনন্দে। আহ! কী আনন্দ ওই রাধাচূড়ার গায়ে। ফুল ফুটে চারদিকে যেন মৌ মৌ  করছে। আর ভ্রমরা উড়ে উড়ে নেচে বেড়াচ্ছে। ফুলের  উপর বসছে। জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে। আবার উড়ে বেড়াচ্ছে। আনন্দের সীমা নেই। রাধাচূড়ার গায়ে যেন সুখের মেলা বসেছে। পাশের দেয়ালরে কার্নিশের মৌচাক থেকে মৌমাছিরা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে ছুটে ছুটে যাচ্ছে মধু সংগ্রহের আশায়। পৃথিবীর বুক জুড়ে এত সুখ এত সুখ আর আনন্দ ছড়িয়ে আছে তা সৈকতের জানা ছিল না। কোনদিন এ নিয়ে ভাববার ফুরসৎ পায় নি অথবা ভাবেই নি। আশেপাশের  বস্তুজগৎ যে  এত আনন্দ দিতে পারে, মনের অন্তহীন গহীনে দাগ কেটে যেতে পারে তা ধারণার বাইরে ছিল। এক জোড়া ঘন পল্লব ঘেরা শীতল চোখই ওকে এ আনন্দের স্বর্গভূমির সন্ধান দিয়েছে আজ। ওই জোড়া চোখের গভীরতা সমুদ্রের চেয়েও অধিক ছিল। জোড়া চোখের  জ্যোতিতে সৈকতের আয়ু ছিল কয়েক সেকেন্ডের। চোখে চোখ। কয়েক সেকেন্ড অতিবাহিত হওয়া তারপর সৈকত নিজের অস্তিত্বের নিখোঁজ সংবাদ পেল হৃদয়ের প্রতিটি শিরা-উপশিরায়। ভোর ছ’টায় বন্ধু অনিককে নিয়ে সৈকত *ডাসের পাশের যাত্রী ছাউনিতে রুচিদির জন্য অপেক্ষা করছে। একসাথে রমনা বটমূলে যাবে। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় নি। রুচিদি একা আসে নি। সাথে আরও কয়েকজন এসেছে। এসেই সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। পরিচয় পর্ব শেষ করেই সবাই পা চালাল রমনা বটমূলের উদ্দেশ্যে।  

 

আজ পহেলা বৈশাখ। রমনা বটমূল। লোকে লোকারণ্য। সাংস্কৃতিক দলের সংগীত পর্ব চলছে। ওরা সবাই  এক কোণে জায়গা করে দাঁড়াল। এমন পরিবেশের সংস্পর্শে আসলে যুগ যুগ বাঁচার ইচ্ছেটা মাথায় মুকুটের মতো চেপে বসে; এ মুহুর্তে অন্তত এ চিন্তাটাই সৈকতের মনের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। মানুষ যে সুন্দরের পূজারী এখানে এলেই যে কেউ বুঝতে পারবে। কেউ কেউ হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে ঘাসের ওপর লেপটে বসেছে। এখানে কেউ একা আসেনি। কেউ এসেছে বন্ধু নিয়ে, কেউ বা প্রিয় বান্ধবী, কেউ তার প্রেমিক অথবা প্রেমিকাকে নিয়ে আবার কেউবা তার পুরো সংসার নিয়েই এসেছেন। 

 

এই ভোরের বাতাসে রবীন্দ্র সঙ্গীতের সুর মনকে শান্ত সুস্নিগ্ধ করে তোলে। মনের ভেতর আনন্দেরা নাচানাচি শুরু করে দেয় ধেই ধেই করে। সৈকত গভীর মগ্ন হয়ে গান শুনছে। আনন্দের এই আনন্দধারায় নিজেকে সঁপে দিয়েছে। সে এখন বাস্তব জগতের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে অন্য এক অচেনা মানুষ। কিন্তুু কী এক মধুর আহব্বানে হঠাৎ দৃষ্টি যুগল পোঁছে গেল সদ্য পরিচিত পারমিতার চোখে। পারমিতার চোখে জোড়া শান্ত-গভীর হয়ে টেনে নিল সৈকতের দৃষ্টিসীমা। সৈকত টের পেল যে এই চাহনির পরিসীমা বুকের গভীরতাকে ছুঁয়ে গেছে। একটা অস্বস্তিকর অবস্থার মাঝে সৈকত পড়ে আছে। গানে আর মন স্থির রাখতে পারছে না সৈকত।

সৈকতের খুব ইচ্ছে হচ্ছে চোখ জোড়া ভাল করে পরখ করার। কিন্তুু সাহসে কুলোচ্ছে না; পারমিতা হয়ত এদিকেই তাকিয়ে আছে এই ভয়ে। মনটা ভীষণ রকম উসখুস করছে সৈকতের। ভেতর জগতটা ক্ষণিকে ক্ষণিকে ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে। আচমকা ভূমিকম্পে সাজানো নগর যেমন তছনছ হয়ে যায় তেমনি হয়ে গেছে সৈকতের ভেতরটা।

 

ইচ্ছের বিরুদ্ধে সৈকত আবার তাকাল। পারমিতা একই ভঙ্গিমায় তাকিয়ে আছে। কয়েক সেকেন্ডের পলকহীন শুনসান নীরবতা। তারপর দু’জনই লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেল। কয়েক যুগের ছবি আঁকা হয়ে গেছে এই মুহূর্তের সিঁড়িতে। দু’জনার প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয়েছে একই নিসর্গের ভূমিকায়। পাশের অন্য কেউ লক্ষ্য করেনি দুটি মনের অবাধ চঞ্চলতা।

আনন্দের অস্বস্তি সৈকতকে কাবু করে ফেলল। ভীষণ একা থাকতে ইচ্ছে করছে এই সুখময় মুহূর্তে। আনন্দ বয়ে বেড়ানোর মত শক্তি যেন নেই। নিঃশেষ হয়ে গেছে চোখের পলকে। আনন্দ এবং সুখের ভারে ন্যুজ হয়ে সৈকত রুমে ফিরল দুপুর বেলায়।

রুমে এসেই চেয়ার দখল। চোখ জোড়া জানালা গলে আকাশ। দেয়ালের কার্নিশে মৌমাছির ব্যস্ততা। জানালা বরাবর রাধাচূড়ার মোহনা। সবকিছুতেই যেন আনন্দের আবীর জড়িয়ে আছে। আর সৈকত হাবুডুবু খাচ্ছে আনন্দের জলসায়।

রুমে কখন এসেছিস?

অনিকের ডাকে সৈকতের তন্ময়তা কেটে গেল। তারপর ভাবনার জগৎ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে সৈকত বলল- অনেকক্ষণ। বিকেলে টিএসসিতে তোর যাবার কথা। আমরা সবাই সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি তোর জন্য। আর তুই কিনা রুমে বসে বসে ধ্যান করছিস। চল, তাড়াতাড়ি চল। সবাই তোর জন্য অপেক্ষায় আছে। 

অলসতা জড়ানো কন্ঠে সৈকত জানাল, শরীরটা ভালো লাগছে না। এখন আর বের হবো না। অনিক সৈকতের কপালে হাত ছুঁয়ে বলল, শরীরতো ঠিকই আছে দেখছি- অনিক বলল। 

উত্তাপ মেপেই কি সবসময় রোগের যাচাই হয়? তেমন কিছুই হয়নি।- সৈকত এড়িয়ে যাবার  চেষ্টা করে। 

তাহলে?- এই বলে প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে অনিক সৈকতের চোখে চোখ রাখল।

এখন বের হতে একদম ইচ্ছে হচ্ছে না।

সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করছে। আর তুই বলছিস যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। এটা কোন কথা হল? তাছাড়া এই অবেলায় রুমে বসে থেকে করবিটা কী?

প্লিজ কিছু মনে করিস না। আজকের দিনটা ম্যানেজ করে নে ।

তুই আসলেই একটা উদ্ভট প্রকৃতির মানুষ। এই মেঘ, এই রোদ্দুর। সকালে খোশ মেজাজে এক সাথে বের হলাম। আর পরক্ষণ থেকেই দেখি তোর মেজাজ কালো মেঘ হয়ে আছে, ব্যাপারটা কী? তোকে কি কেউ কিছু বলেছে?- অনিক জানতে চায়।

আমাকে কে আবার কী বলবে?- না তাকিয়েই সৈকত জবাব দেয়।

তাহলে অমন গোমরামুখো হয়ে বসে আছিস যে?

সুখে!- কন্ঠে কপটা-রাগ ঝরিয়ে সৈকত বলল। আর মনে মনে বলল, তোকে সত্যি কথাটাই বললাম। অনিক আর কথা বলল না। তবে প্রতি পদক্ষেপে অভিমান ঝরে পড়ল। অনিক চলে যেতেই সৈকত আপন মনে হাসল; জানিস না অনিক, আমি আনন্দের দাপটে অসুস্থ হয়ে পড়েছি। 


[প্রিয় পাঠক,লেখাটি আপনার কেমন লাগল ? প্রতি শুক্রবারে প্রকাশ হবে এই উপন্যাসের একেকটি পর্ব । আপনাদের মন্তব্য জানাতে পারেন কমেন্ট বক্সে । ]

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ