পারমিতার বড়দিদি সুদেষ্ণা। স্বামীসহ ধানমন্ডি পনের নম্বর থাকেন। ভাড়া বাসা। স্বামী অভীক মজুমদার ব্যাংক কর্মকর্তা। দিদিদের নতুন সংসার।
দিদির পীড়াপীড়িতেই পারমিতাকে প্রায়ই বাসায় যেতে হয়। দুলাভাইটি বেশ ভালো মানুষ। বাসায় বেড়াতে গেলে বেশ খুশী হন। দিদি বলেছিলেন, নববর্ষের দিন দুপুর বেলায় বান্ধবীদের নিয়ে বাসায় যেতে। কিন্তুু পারমিতা গতকাল সন্ধা পর্যন্ত টিএসটিতেই বন্ধু বান্ধবীদের সাথে কাটিয়েছে। তারপর *রুচিদিকে নিয়ে বাসায় এলো।
গতরাতটা পারমিতার এক অচেনা আচ্ছন্ন জগতে কেটেছে। সৈকতকে দেখার পর থেকেই প্রতিটি মূহূর্ত কেটেছে ভাবনার অতলে ডুবে ডুবে। এমন তো তার কখনও হয়নি। দেখার পরই পারমিতার মনে হয়েছে সৈকত যেন ওর কাছে যুগ যুগ ধরে চেনা। মাঝখানে কিছুদিন অন্তরাল। আবার দেখা। অথচ সত্যিকার অর্থে সৈকতের চোখ জোড়ায় পারমিতা গতরাত সর্বক্ষণ ডুবেছিল এক অদৃশ্য টানে। পারমিতা ভেতরে ভেতরে ভীষণ ছটফট করছিল। কিন্তু *রুচিরাকে তা বুঝতে দেয় নি। যতই রাত বাড়ছিল ততই যেন সৈকতকে দেখার ইচ্ছেটা অবাধ্য হচ্ছিল। পারমিতার ভাবনার জগৎ জুড়ে এখন শুধু সৈকত।
পারমিতা ও রুচিরা যখন বাসার বাইরে পা বাড়াল তখন বেলা সকাল ৯টা কী সাড়ে ৯টা হবে। রিকশা নিয়ে সোজা ক্যাম্পাসে চলে এল। ডিপার্টমেন্টের সামনে এসে পারমিতা বলল, রুচিদি আপনি সৈকতকে নিয়ে এসে এখানে অপেক্ষা করবেন। আমি ক্লাসটা সেরেই সোজা এখানে চলে আসব।
রুচিরা চলে আসে দর্শন বিভাগের সামনে তেমন কেউ নেই এখানে। রুচিরা মনে মনে ভাবল, দাঁড়ালে অন্ততপক্ষে একটা ঘন্টা দাঁড়াতে হবে। তাও আবার একা। মনটা একটু খারাপ হয়ে যায়। রুটিন বোর্ডটার দিকে রুচিরা এগিয়ে যায়। রুটিন বোর্ড থেকে খুঁজে বের করে নেয় সৈকতের ক্লাসরুমের নম্বরটা। তারপর হেঁটে চলে ওই দিকে।
স্যার ক্লাস নিচ্ছেন। কয়েকবার এপাশ ওপাশ হাঁটল রুচিরা কিন্তুু সৈকতকে চোখের সীমানায় আনতে পারে নি । তারপর সৈকতকে দেখা যায় এমন জায়গায় দাঁড়াল। কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই সৈকতের চোখ রুচিরার ওপর পড়ল। রুচিরা সৈকতকে চোখে ইশারা করল বেরিয়ে আসতে।
মিনিট পাঁচেক পরই সৈকত ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে এল। বেরিয়ে এসেই সৈকত বলল, কী ব্যাপার রুচিদি? হঠাৎ ক্লাস রুমেই ডাক পড়ল।
রুচিরা হাত ঘড়িটা দেখে নিল। তারপর বলল- চল এক জায়গায় যেতে হবে। কথাগুলো বলেই রুচিরা হাঁটতে শুরু করল।
সৈকত কোন কথা বলল না। রুচিরার পায়ের তালে তালে পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। সৈকতের ইচ্ছে হচ্ছিল পারমিতার কথা জিজ্ঞেস করে। কিন্তুু কথাটা বুকের ভেতরই বারবার ঘুরপাক খেল। সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সামনে এসে রুচিরা বলল- এখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি। ক্লাস শেষেই পারমিতা চলে আসবে।
পারমিতার কথাটা কানে পোঁছামাত্রই সৈকত যেন বিদ্যুৎষ্পৃষ্ট হল। তন্ময়তার ঘোর ভাবটা কাটিয়ে সৈকত বলল, আচ্ছা ঠিক আছে। সৈকতের কণ্ঠস্বরটা কেমন যেন একটু অচেনা মনে হল। আসলে পারমিতা ওর ভাবনার অলিতে-গলিতে বিচরণ করছিল। তাই স্বর ফুটে কথাটুকু সম্পূর্ণ বেরিয়ে আসেনি। আর রুচিরা ভাবল, হয়ত সৈকতের ক্লাসটা করার ইচ্ছে ছিল অথবা অন্যকিছু। তাই রুচিরা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল- সৈকত কিছু মনে করো না প্লিজ, তোমাকে ডেকে এনে অসুবিধায় ফেলিনি তো?
সৈকত বালকসুলভ অভিমানে বলল- দিদি, আপনি এতদিনে আমাকে এতটুকু চিনলেন?
রুচিরা দুহাতে সৈকতের একটা হাত টেনে ধরে বলল, প্লিজ লক্ষী ভাইটি রাগ করো না। আসলে আমি কথাটি ওভাবে বলিনি।
কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে তারপর সৈকত রুচিরার দিকে তাকায়। রুচিরা সৈকতের হাত ছেড়ে দিয়ে পাশাপাশি হয়ে দেয়ালে কনুই চেপে দাঁড়ায়। সৈকত বলে- রুচিদি, যে কোন কাজে এই ছোট ভাইটিকে স্বরণ করবেন। দেখবেন বান্দা হাজির।
রুচিরা মিষ্টি হেসে বলে- ঠিক আছে, অবশ্যই ডাকব।
চলুন, চা খেয়ে আসি। হাতে এখনও অনেক সময় আছে।- প্রসঙ্গ ঘোরাবার প্রয়াসে সৈকত বলে।
রুচিরা বলে- পারমিতা আসুক। একসঙ্গেই খাওয়া যাবে, কি বলো?
হ্যাঁ, অবশ্যই। রুচিরার কথাটুকু সৈকতের খুবই ভালো লেগেছে। আর সত্যি বলতে কি, সৈকত মনে মনে এটাই চেয়েছিল।
তারপর পারমিতার জন্য অপেক্ষা । সময় পেরিয়ে পারমিতা এসে হাজির হয় যথাসময়ে। সৈকতের কাছাকাছি হতেই পারমিতা কিছুটা অপ্রস্তত হয়ে যায়। সৈকত পারমিতার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারছে না।
অপ্রস্তুতের ছন্দপতন ঘটিয়ে পারমিতা বলে- আপনাদের অনেকক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখলাম দিদি।
রুচিরা বলে সময়টা খারাপ কাটে না। সৈকতকে ক্লাস থেকে বের করে নিয়ে এসেছি।
সৈকতের দিকে তাকিয়ে পারমিতা হাসে। পারমিতার হাসিতে সৈকতের ভেতর ভুবন কেঁপে ওঠে। প্রকাশ পায় হাসিতে। দিদি, চলুন চা খাওয়া যাক।- এই বলে সৈকত দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।
হ্যাঁ, চল।- রুচিরা বলে।
তারপর হাঁটতে শুরু করে। চলে আসে ডাকসু ক্যাফেটেরিয়াতে। রুচিরা পার্সে হাত ঢুকাতে যায়। সৈকত বলে- আপনারা গিয়ে বসুন, আমি নিয়ে আসছি।
উত্তরের জন্যে অপেক্ষা না করে সৈকত কাউন্টারের দিকে পা বাড়ায়। রুচিরা পেছন থেকে ডেকে বলে দেয়- শুধু চা হলেই চলবে।
সৈকত কোন জবাব দেয়নি। রুচিরা ও পারমিতা একটা টেবিল দখল করে পাশাপাশি বসে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই একটা ট্রে হাতে সৈকত হাজির হয়। তিনটি সমোচা আর তিন কাপ চা। ট্রে-টা টেবিল রাখতে রাখতে সৈকত বলল- আমি পানি নিয়ে আসছি, একটু বসুন।
সৈকত এক দৌঁড়ে গেল আর এল। তারপর পানির দুটো গ্লাস টেবিল রাখল। ট্রে-টা পারমিতার দিকে এগিয়ে দিয়ে সৈকত বলল নিন, শুরু করুন।
পারমিতা হাত বাড়িয়ে একটা সমোচা তুলে নেয়। রুচিরা একটা সমোচা হাতে নিতে নিতে বলল- সৈকত, আপনি নয়, তুমি বল, ও তোমার পরের ইয়ারে।
হয়ে যাবে, কিছুক্ষণ আপনি আপনি চলুক, তারপর হয়ে যাবে। - কথা শেষ করে সৈকত হাসে।
রুচিরা বলে- আপনি বলার কোন প্রয়োজন নেই।
রুচিদি ঠিকই বলেছেন। আপনি আমার সিনিয়র অতএব এখন থেকেই আমাকে তুমি বলবেন। -পারমিতা খুব সুন্দরভাবে কথাগুলো গুছিয়ে বলে।
এটা-সেটা আলাপ-চারিতায় চা-পর্ব শেষ হয়। তারপর ক্যাফেটেরিয়া থেকে ওরা বের হয়ে আসে। এক রিকশায় তিনজন চেপে বসে। সৈকত বসল সিট ব্যাকের উঁচুটায়। আর ওরা দু’জন সিটে বসল। রিকশা আসাদ গেটের উদ্দেশে রওনা হল। সৈকত বারবার ভাবছে; পারমিতা এত নিকটে আসবে তা গতকালও ছিল স্বপ্ন। নিজস্ব ভুবনে সৈকত মশগুল। অবশ্য পারমিতাও এই মুহুর্তে সৈকতের সংস্পর্শে এসে নিজেকে সুখী জগতের একজন বাসিন্দাই ভাবছে।
আড়ংয়ের সামনে এসে রিকশা থামল। ভাড়া মিটিয়ে শেষে রুচিরা বলল- তোমরা নিচেই অপেক্ষা কর। আমি কাজটা সেরে আসি। কী বল পারমিতা?
মাথা কাত করে পারমিতা বলে- হ্যাঁ, ঠিক আছে।
রুচিরা সিঁড়িতে পা রাখে। অদৃশ্য হয়ে যায় ওদরে চোখে সীমানা থকে।
সৈকত পারমিতাকে বলে চলো, আমরা মার্কেটটা একটু ঘুরে ঘুরে দেখি।
হ্যাঁ, মন্দ হয় না।
সৈকত ও পারমিতা এদিক-ওদিক কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে। দু’জনার মাঝে কথাবার্তা খুবই কম হচ্ছে। সৈকতের ইচ্ছে হচ্ছে পারমিতার সাথে কথা বলার। কিন্তু কথা বলতে গিয়ে তেমন কোনো ধারাবাহিকতা পাচ্ছে না। হাঁটতে হাঁটতে সিঁড়ির গোড়ায় চলে এল। রুচিরা আসে নি এখনও। ওরা আবার হাঁটতে থাকে। দু’জন পাশাপাশি । এক সময় কোনো কথা খুঁজে পায় না সৈকত । আর পারমিতা তো সেই কখন থেকে চুপচাপ শুধু শুনেই যাচ্ছে। আর মাঝে মাঝে টুকটাক কথা বলছে। ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোর সামনে এসে অপ্রয়োজনীয় অথচ মনোযোগী দৃষ্টি বুলাচ্ছে দু’জন। পেছন থেকে রুচিরা ডাকে। কাছাকাছি হতেই রুচিরা সহাস্যে বলে- আজ চাকরিটা কনফার্ম হল। সৈকত ও পারমিতা দু’জনই একসাথে বলে ওঠে কনগ্র্যাচুলেশানস্ ।
দু’জনের খুশীতে রুচিরার মনটা পুরোপুরি সুখী হয়। তারপর বলে- আজ সারাদিন তোমাদের নিয়েই ঘোরাঘুরি করবো। কি বলো, তোমাদের কারও আপত্তি নেই তো?
দু’জনই একসাথে বলে না।
রিকশা নিয়ে পাবলিক লাইব্রেরিতে চলে আসে। দুপুরের খাবার পাবলিক লাইব্রেরির ক্যান্টিনেই খায়। তারপর সবুজ ঘাসের বুকে পেতে বসে চলে গল্পের পশরা। এখানেই সৈকত ও পারমিতা একজন অন্যজনের কাছে পরিচিত হয় নতুনভাবে । গল্পের ভেতরেই পারমিতা খুঁজে পায় মনের মানুষের আংশিক চেনা আঙিনা। আকাশ যেমন সবুজ প্রান্তকে ছুঁয়ে থাকে তেমনই দূরত্বে থেকেও সৈকত ছুঁয়েছে পারমিতার মনের বাগানকে । সন্ধ্যা নাগাদ ওরা টিএসসির দিকে পা বাড়ায়।
0 মন্তব্যসমূহ