সর্বশেষ

10/সর্বশেষ/ticker-posts

ভাষার দ্বন্দ্ব : ইংলিশ মিডিয়াম ভার্সেস বেঙ্গলী মিডিয়াম :- পর্ব ১

 


 

ডঃ গৌতম সরকার


সকলের মতো জীবনের বিভিন্ন সময়ে ভাষার দ্বন্দ্বে আমাকেও পড়তে হয়েছে, তবে আমি ভাগ্যবান আমার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ স্মৃতিই মজার ও মধুর, খুব কম ক্ষেত্রেই তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে ; তবে ওইটুকু তিক্ততাই মাঝে মাঝে বেশ নাড়া দিয়ে যায় I

' পিয়াসাড়া অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ' আমার শিক্ষা শুরু হয় , বাবার সময় ছিল না ; মায়ের বারংবার অনুরোধে পাড়ার এক দাদা একদিন হাত ধরে নিয়ে গিয়ে স্কুলে ভর্তি করে দেয়৷ গ্রামের এক অখ্যাত বেঙ্গলী মিডিয়াম স্কুল - সেই সময় ওই গন্ডগ্রামে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া তো দূরের কথা, কয়েকশ মাইলের মধ্যে ইংরেজি মাধ্যমের কোনো স্কুল আছে কিনা তার খবরই কেউ রাখতো না৷ তাতে কিন্তু কোনো অসুবিধাই টের পাইনি৷ তখনও ইংরেজি ভাষাটাকে নিয়ে পরীক্ষা - নিরীক্ষা শুরু হয়নি, ফলে আমরা ক্লাস ওয়ান থেকেই ইংরেজি পড়েছি ; বাংলাই বেশি আর ইংরেজি যতটুকু দরকার৷ মাস্টারমশাইরা একই রকম যত্নে তাঁদের সাধ্যমত দুটো ভাষাই শেখাতেন৷ কিন্তু ইংরেজি ভাষাকে কখনোই যেমন জুজুবুড়িও মনে হয়নি তেমনি এটা একটা বিদেশী ভাষা সেটাও বুঝতে পারিনি, আরোও পাঁচটা বিষয়ের মতো এটাও একটা বিষয় হিসেবেই পড়তাম৷ তবে এটা একদম সত্যি এই ভাষার শিক্ষা শিক্ষকদের পড়ানো এবং পড়ার বইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত ; কারন একদিকে তখন যেমন ইংরেজি নিউসপেপারের কথা ভাবতেও পারতামনা, তেমনি টিভির ইংলিশ চ্যানেল রূপকথার গল্পের মতো অলীক ছিল৷ কিন্তু তাতে কিছু আটকায়নি, জীবন নিজের মতো বয়ে গেছে, প্রচুর মজা করে শৈশব কাটিয়েছি, ইংরেজি কমজানি বলে জীবনের কোনোরকম আনন্দ থেকে বঞ্চিত হইনি৷

 

ওইটুকু ইংরেজি জ্ঞান নিয়েই ক্লাস ওয়ান থেকে কানে ট্রানজিষ্টর লাগিয়ে ভারত - ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্টম্যাচের ধারাবিবরণী শুনেছি ; গাভাস্কার, কালীচরণ, রিচার্ডসের প্রতিটি শট বুঝতে পারতাম ; রবার্টস, গার্নার, কপিলের প্রতিটি বলের পেস আর স্যুইং বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হতনা৷ এইভাবেই ইংরেজিতে বিন্দুমাত্র ভয় না পেয়ে প্রাইমারী স্কুল ছেড়ে হাই স্কুলে ভর্তি হলাম৷ এখানে এসে অনেক বন্ধুর সাথে মোলাকাত হল যারা ইংরেজিকে ভূতের মতো ভয় খায়, আমার একটু মজাই লাগতো, স্কুলের ইতিহাসে এমন রেকর্ডও ছিল, ফার্স্ট ডিভিশন পেয়ে ইংরেজিতে কম্পার্টমেন্টাল পেয়েছে৷ আমার কেন কে জানে ভয় লাগতো না, বরং বিষয়টা বেশ ভালোই লাগতো৷ মোটামুটিভাবে শুদ্ধ সেনটেন্স লিখতে পারতাম, টেন্সটা মন দিয়ে শিখেছিলাম মনে আছে৷ এই অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস পরবর্তীতে আমার সর্বনাশ ডেকে আনল, অ্যাভারেজ ছাত্রদের থেকে ওই বিষয়ে একটু ভালো হওয়ায় মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে গেলাম শুধু কবিতা আর গল্পগুলো পড়ে, না কোনো প্রশ্ন - উত্তরের প্রস্তুতি, না কোনো মুখস্ত এসে -লেটার রাইটিংয়ের সম্ভার ( কারন তখন ধারণা ছিল, যাই আসুক না কেন নিজের ইংরেজি জ্ঞানে তার সবকটাই ফাটিয়ে দেব ); ফলশ্রুতি হল পরীক্ষায় ইংরেজিতে খুব খারাপ রেজাল্ট হল, বন্ধুরা আড়চোখে তাকিয়ে মুখ লুকিয়ে একটু হেসেও নিল৷ তাদের দোষ দিই না কারন আমিও তো বেশ কয়েকবছর ধরে ওদের কাছে জামার কলারটা একটু বেশিই তুলে ফেলেছিলাম৷ হায়ার সেকেণ্ডারীতে খুব যে নিজেকে পরিবর্তন করলাম তা একেবারেই নয় ; একই রকমভাবে নোট মাফিক না পড়ে শুধু রিডিং পড়ে পরীক্ষা দিতে গেলাম, তবে এবার পড়ার পরিধিটা একটু বাড়িয়ে দিলাম, যেমন, এবার প্রতিটি কবিতা ও গল্পের ক্রিটিকাল অ্যানালিসিস ইত্যাদি পড়েছি, রেজাল্ট একটু ভালো হল কিন্তু দারুণ কিছু নয়৷

 

 যাই হোক যেহেতু উচ্চশিক্ষায় ইংরেজি সাহিত্য থেকে সহস্র যোজন দূরের এক সাবজেক্ট অর্থনীতিকে বাছলাম তাই অল্পবয়সের ওই উন্নাসিকতা অতটা ক্ষতি না করলেও কিছুটা অবশ্যই করেছিল সেটা এই বয়সে আরো বেশি করে উপলব্ধি করি৷ কলেজে গিয়ে বাংলার সাথে একদম আড়ি, কোনো উপায় নেই কারন ইকনমিক্স অনার্সে ইন্ডিয়ান লেখকের কোনো বই ছিলনা ; ফলে এবার পুরোপুরি ইংরেজ সাহেব হয়ে উঠলাম, কিন্তু মজা বাদ দিয়ে যদি বলি - কোথাও কিন্তু কোনো হোঁচট খেতে হয়নি, রাতারাতি নিজেকে উত্তমকুমার থেকে গ্রেগরি পেক বানাতে বিশাল কিছু কাঠখড় পোড়াতে হয়নি, কিরকম স্বাভাবিক ভাবেই হয়ে গেছে৷ কিন্তু আবার একটু ‘এয়ার’ নেওয়ার সুযোগ এসে গেল, কলেজে যাবার পথে জামার ওপরের দুটো বোতাম খুলে হাতে রায়ান অ্যান্ড পিয়ার্সের 'প্রাইস থিওরী' নিয়ে বাসে চড়ে কলেজ যাতায়াত শুরু করে দিলাম৷ গ্রাম-গঞ্জের অতি সাধারণ, অশিক্ষিত মানুষজন একটু সমীহের চোখে ওই দুর্বোধ্য বইয়ের দিকে দুবার আর আমার মুখের দিকে পাঁচবার তাকাতে লাগলো, আর আমার বুক ফুলে কলাগাছ৷ বাড়িতেও একটা অন্যরকম সুবিধা নিতে শুরু করলাম, মোটা মোটা ইংরেজি বইগুলোকে ভাগের বইয়ের আলমারিতে সামনের তাকে জায়গা করে দিলাম৷ তবে তার সাথে আমরা কিন্তু পড়াশোনাটা করতাম৷ সবথেকে বড় কথা ভাষাটা কখনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি, অর্থনীতি বিষয়টাও আস্তে আস্তে বুঝতে শুরু করলাম, একটা ভালো লাগাও যেন তৈরী হল৷ রেজাল্ট যে ফাটাফাটি হল তা নয়, কিন্তু বিষয়টার প্রতি একটা আকর্ষণ তৈরী হল যেটা পরবর্তী সময়ে আমাকে খেয়ে পড়ে, ঘুরে - বেড়িয়ে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে চলেছে৷                          

      (ক্রমশঃ…..)

লেখক: অর্থনীতির সহযোগী অধ্যাপক



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ