সর্বশেষ

10/সর্বশেষ/ticker-posts

বেঙ্গলী মিডিয়াম ভার্সেস ইংলিশ মিডিয়াম-পর্ব ২

 



ডঃ গৌতম সরকার

পার্ট টু পরীক্ষার পর টানা তিনমাস ছুটি, শুধুই আড্ডা - বন্ধুদের সাথে ক্রিকেট, রাজনীতি, সমাজনীতি নিয়ে চায়ের কাপে তুফান তোলার বয়স সেটা ; রোজ বিকেলে এক কিলোমিটার সাইকেলে গিয়ে বাসে পাঁচ-ছ কিলোমিটার উজিয়ে আড্ডা মারতে যেতাম, ফিরতাম শেষ বাসে চেপে৷ ফিরতে প্রায় রাত সাড়ে দশটা হয়ে যেত, আমার ছোড়দি ঘুম ঘুম চোখে নিত্যদিন খাবার নিয়ে বসে থাকতো৷ তবে বেশিদিন এই সুখের সময় টিকলো না, আস্তে আস্তে রেজাল্ট বেরোনোর সময় এসে গেল, দারুণ হবে কখনোই আশা করিনি কিন্তু কতটা খারাপ হবে সেটা ভেবেই মাঝে মাঝে বুক শুকিয়ে যেত৷ অবশেষে রেজাল্ট তার নিজের মতো বেরোলো আর আমিও আমার মতই করলাম, তবে এক অমোঘ সত্যের উপলব্ধি ঘটল - এই রেজাল্টে আর যাই হোক ভালো কোনো ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স পড়ার সুযোগ পাবোনা৷ দুয়েকটা জায়গায় চেষ্টা করলেও মনে মনে প্রস্তুত হলাম বর্ধমান ইউনিভার্সিটিতে পড়ার জন্য তাও যদি এখানেও আদৌ সুযোগ পাই ! এই ভাবে আড্ডা - টেনশন - টেনশন - আড্ডায় সময় কাটতে লাগলো৷ একদিন চাঁপাডাঙায় আমাদের ঠেকের ছাদে যথারীতি আড্ডা মারছি, এমন সময় আমার এক বন্ধু ধূমকেতুর মতো এসে খবর দিল - যাদবপুরে হয়ে গেছে - খবরটা এতই আকস্মিক যে ধাতস্থ হতে বেশ কিছুটা সময় লাগলো, এটা তো একদম আকস্মিক - আমি স্বপ্নেও ভাবিনি, আমার স্বপ্নের যাদবপুর ! গ্র্র্যাজুয়েশনের সময়েই জেদ ধরেছিলাম এখানে ভর্তি হবার জন্যে কিন্তু প্যানেলে আসিনি, তাই মাস্টার্সে এই প্রিয় ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির সুযোগ পাবার খবর শুনে আমার কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা৷ কিন্তু দ্বিতীয় খবরটা শুনে আমার পিলে চমকে গেল, সেটা হল - পরের দিনেই ভর্তির লাস্ট ডেট, অর্থাৎ লিস্ট আগেই বেরিয়েছে আমি চান্স পাবোনা জেনে আর ফালতু পয়সা আর সময় নষ্ট করে কলকাতা যাইনি, ভাগ্যিস আমার বন্ধু কল্যাণীফেরত যাদবপুরে একবার ঢুঁ মারতে গিয়েছিল ( ওই বন্ধুও ওখানে একই সাবজেক্টের জন্য অ্যাপ্প্লাই করেছিল এবং পরে ও ওখানে ভর্তির সুযোগও পায় )৷ এবার আমার টেনশন শুরু হল, কালকে কী কী নিয়ে যেতে হবে ওই বন্ধু একটু আন্দাজ দিল, তড়িঘড়ি বাড়ি ফিরলাম, বড়দিকে খবরটা জানালাম, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অতগুলো টাকার ব্যবস্থা দিদি কিভাবে করলো জানিনা - পরের দিন সকালে দিদির দেওয়া টাকা, আর অরিজিনাল সার্টিফিকেটগুলো নিয়ে গাঁয়ের এক বাংলা মিডিয়ামে পড়া ছেলে কলকাতা নামক এক মহানগরের উদ্দেশ্যে দুরুদুরু বক্ষে রওয়ানা হল৷ 

    ভর্তি হতে গিয়ে দেখা গেল - ভর্তির জন্য ছেলেটি অনেক কিছুই আনেনি, ছবি লাগবে, প্রত্যেক সার্টিফিকেটের ফটোকপি লাগবে, কিছুই সে আনেনি ; কলকাতার সে কিছুই চেনে না, একলা এই প্রথমবার কলকাতায় আসা, এর আগে প্রতিবারই এসেছে দিদির সাথে, তাছাড়া এখানকার অফিস থেকে বলল এক ঘণ্টার মধ্যে এই সবকিছু যোগাড় করতে হবে কারন ভর্তির সময় দুপুর দুটো পর্যন্ত৷ এদিকে সময় বহিয়া যায়, নদীর স্রোতের প্রায়৷ একটা গ্রামের ছেলে যে হাওড়া থেকে যাদবপুর আসতে গিয়েই পঞ্চাশজন মানুষের সাহায্য নিয়েছে, সে এক ঘন্টার মধ্যে কোথা থেকে এতকিছু জোগাড় করবে, বিশেষত ছবি ! তখনতো আজকের মতো ' Passport photo in one minute ' চালু হতে কুড়ি বছর বাকি, ফটোকপি হয়তো চেষ্টা করলে যোগাড় হবে কিন্তু এই সময়ের মধ্যে ছবি- নৈব নৈব চ ! আমার অবস্থা তখন সঙ্গীন, পিয়াসারা অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছেলেটা এমন একটা সুযোগ পেয়েও তার স্বপ্নটাকে হারাবে শুধু দু কপি ফটোর জন্যে ? আমি যখন প্রচন্ড থতমত খেতে খেতে ওই কাউন্টারের ভদ্রলোককেই জিজ্ঞাসা করার চেষ্টা করছিলাম, - আমি কি করব ! তখন জানতাম না আমার অলক্ষ্যে শুভ্র ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত এক ভদ্রলোক আমাকে খেয়াল করছিলেন, আমার অবস্থা দেখে উনি এগিয়ে এলেন, আমার কাঁধে তাঁর প্রশস্ত হাত রেখে জিজ্ঞাসা করলেন, " কি সমস্যা ?" আমার তখন চোখে জল, হাত-পা কাঁপছে৷ উনি সব শুনে আমাকে আশ্বস্ত করলেন৷ উনি ওখানকার এক কর্মচারী, নিজের কাজ ছেড়ে উঠে এসেছেন, আমাকে নিয়ে চললেন, সারা পথে ওনার আশ্বস্ততার হাত আমার কাঁধ ছাড়েনি৷ তারপর আমার কাছে সবটাই ম্যাজিক ! কখন, কিভাবে ওই এক ঘণ্টার মধ্যে সবকিছু যোগাড় করে আমার স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম আমি নিজেও মনে করতে পারিনা ; শুধু মনে পড়ে সব কিছু মিটে যাবার পর যখন ওই ভগবানকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে গেলাম তখন উনি ওনার সবল দুই হাতে মাঝপথেই আমাকে থামিয়ে দিলেন৷ তারপর বহুবছর যাদবপুর ও আশেপাশে থাকার কারণে ওনার সাথে সহস্রবার দেখা হয়েছে কিন্তু একবারের জন্যও উনি আমাকে ওনার পা ছুঁতে দেননি, যেটা আমার জীবনের একটা চরম আক্ষেপ হিসেবেই থেকে গেছে৷ কিন্তু একই সঙ্গে ওইদিনই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে আমি আমার শ্রদ্ধার প্রথম ফুলটি অর্পণ করেছিলাম৷

 

   এখানে ভর্তির সময় একটা ইন্টারভিউ হয়েছিল ছোট করে, মঞ্জুলাদি ছিলেন শুধু - পরিষ্কার মনে করতে পারছি, উনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন গ্র্যাজুয়েশনের পরীক্ষায় আমি কোন ভাষায় উত্তর লিখেছিলাম - আমি উত্তর দিয়েছিলাম, 'থিয়োরী পেপারগুলো ইংরেজিতে আর ইকনোমিক হিস্ট্রিগুলো বাংলায়'-উনি মায়ের স্নেহে হেঁসে বললেন, 'এখানে কিন্তু সবটা ইংরেজিতে করতে হবে, পারবে ?'  আমি বললাম, ম্যাডাম আমি পারবো, কোনো অসুবিধা হবে না৷ ম্যাডাম ততোধিক মিষ্টি হেসে বললেন, 'কেন পারবেনা, নিশ্চয়ই পারবে !' আমার বুকটা বাইশ ইঞ্চি থেকে ছাব্বিশ হয়ে গেল আর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দ্যেশ্যে আমার শ্রদ্ধার দ্বিতীয় ফুলটি অর্পণ করলাম৷ একটা বাংলা মিডিয়ামের ছেলের কাছে এই মহীরুহ বিশ্ববিদ্যালয়ের অযাচিত আন্তরিক আপ্যায়নে, কলকাতা শহর, ইংলিশ মিডিয়ামের এই শহুরে মানুষ সবকিছুকে কেন যেন খুব আপন মনে হল৷ ক্লাস শুরু হল - কিছুটা বুঝছি, অনেকটাই বুঝছি না কিন্তু ক্লাসমেটদের সাথে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেল৷ একদিন আর্টস ফ্যাকাল্টির পাঁচতলার সিঁড়িতে অফ পিরিয়ডে নতুন বন্ধুদের সাথে আড্ডা চলছে, প্রসঙ্গ অনেক কিছু, কোনো এক আলোচনায় আমি বললাম ,গ্যাঁজা, মনীশ কলকাতা শহরের এক অভিজাত পরিবারের অভিজাত সন্তান,যার কথাবার্তা, আচার-আচরণের মধ্যে ইংলিশ মিডিয়াম খুব সহজাতভাবেই আসে আর যায়, সে খুব নরম সুরে বলল, "গৌতম এটা গ্যাঁজা নয় গাঁজা৷" এতটুকু খারাপ তো লাগলোই না বরঞ্চ আরো ভালোবেসে ফেললাম আর আমার ভালোবাসার প্রথম ফুল অর্পণ করলাম এই বিশ্ববিদ্যালয়কে৷

                                                                           

(চলবে…..)

লেখক: অর্থনীতির সহযোগী অধ্যাপক
কলকাতা,পশ্চিমবঙ্গ,ভারত।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ