মাল্টিপ্লেক্সের পর্দা জুড়ে ওয়েলকাম ব্যাক অর্থ্যাৎ লকডাউন পরবর্তী সময় যেন বেশি করে বুঝিয়ে দিল, বড় পর্দায় ছবি দেখার মজাটা আসলে ঠিক কী রকমের? সেই আনন্দ আরও দ্বিগুণ হয়ে যায় যদি ছবিও মন ভরিয়ে দেওয়ার মতো হয়। অন্য হিন্দি ও ইংরেজি ছবির পাশাপাশি বাংলায়ও পরিচালক মৈনাক ভৌমিকের পরিচালিত “চিনি” চলচ্চিত্রটিও বেশ সারা জাগানো নাম করে, দর্শকের মনে নিজের এক আলাদাই জায়গা করে নিতে সক্ষম।
পুরো চলচ্চিত্র জুড়ে মা-মেয়ের গল্প বলেছেন মৈনাক। মিষ্টি (অপরাজিতা আঢ্য) আর তার মেয়ে চিনির (মধুমিতা সরকার) সম্পর্কটা আর পাঁচটা বাঙালি মা-মেয়ের চেয়ে একটু আলাদাই বলা চলে। আর সেই সম্পর্কের শিকড় যাকে ঘিরে, সেই মানুষটি গত হলেও তার অদৃশ্য উপস্থিতি এখনও ছায়ার মতো লেপটে সারা বাড়িতে। সে বাড়িতে থাকতে পারে না চিনি, যে বাড়ি তার বাবার অত্যাচারে নরকে পর্যবসিত।একটা পর্যায়ে যদিও চিনি বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, তবুও তার অতীতের কথা আর স্মৃতি তাকে তাড়া করে চলছেই। সুদীপের (সৌরভ দাস) সঙ্গে লিভ-ইন রিলেশনে রয়েছে চিনি বহুদিন ধরেই। অফিসে বিজ্ঞাপনের ট্যাগলাইন লিখে, বসের বাঁকা কথা শুনে, থেরাপিস্টের কাছে কাউন্সেলিং করাতে যায়। আসলে চিনির জীবনে শান্তি নেই দু’দণ্ড। তার মা-ও ভাল থাকার পথ খুঁজে নিতে চাইছে নিজের মতো করে। তবুও যেনো তারা ব্যর্থ; খামতি রয়ে গেছে কোথাও একটু।
মিলেনিয়ালদের চেনা দুঃখ, চেনা সুখই তুলে ধরা হয়েছে ছবিতে। দুই প্রজন্মের পরিচিত বিরোধগুলিকেও হাত ধরাধরি করে হাঁটিয়েছেন পরিচালক। রান্নাঘরে আমিষ খেলে যে মা চোটপাট করত মেয়ের উপরে, আলাদা থাকবে বলে যখন ২৪-২৫ বছরের সেই মেয়েই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায়, মা নাড়ুর কৌটো ধরিয়ে দেয় তার হাতে। মেয়ের লিভ-ইন পার্টনারের সঙ্গে দারুণ ভাল সম্পর্ক, এ দিকে পরোক্ষনেই প্রচণ্ড রেগে গিয়ে সেই ছেলেকেই ‘রাস্তার ছেলে’ বলে বসে চিনির মা। এই স্ববিরোধিতা ছবিতে এসেছে মাঝে মাঝেই। মায়ের সঙ্গে, প্রেমিকের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে চিনির দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কারণ হিসেবে দর্শানো হয় তার অস্থির ছেলেবেলা। তার রেফারেন্স চিনি বা তার মায়ের কথাতেই উঠে আসে, যা চিনির প্রেমিকের মতোই দর্শকের কাছেও পৌঁছায় বেশ দেরিতে। অত্যাচারী বাবার গায়ে সন্তানের হাত তোলা, শেষে মারণব্যাধি ধরা পড়ার মতো খুবই প্রত্যাশিত কিছু বাঁক রয়েছে গল্পে, যা তেমন ধাক্কা দেয় না। প্রধান চরিত্রদের দুঃখ, রাগ বা যন্ত্রণাই ছবির অনেকটা জুড়ে। তবে তার সঙ্গে কতটা একাত্ম হতে পারবেন দর্শক, সে প্রশ্ন রয়ে যায়।
অপরাজিতা আঢ্যকে তাঁর চেনা রূপে পাওয়া গিয়েছে ছবিতে, যা ক্ষেত্রবিশেষে উচ্চকিত। মধুমিতা সরকার আবেগের দৃশ্যগুলিতে ভাল, অন্য জায়গায় সামান্য ওভারস্মার্টনেস ছাপিয়ে গিয়েছে তাঁর সহজাত অভিনয়ক্ষমতাকে। তুলনায় সুযোগ কম পেলেও সাবলীল অভিনয়ে নজর কাড়েন সৌরভ দাস। ভাল লাগে ছবির গান, বিশেষ করে লগ্নজিতা চক্রবর্তীর কণ্ঠে ‘তোমার চোখের শীতলপাটি’। ক্যামেরা চার দেওয়ালের বাইরে তেমন বেরোয়নি, যা একটু ক্লান্তিকর। বৃষ্টিভেজার দৃশ্য দেখতেও বেশ লাগে। মৈনাকের ছবির চেনা আস্বাদ এ ছবিতেও বহাল। শুধু চিনিটা মাপমতো হলেই জমে যেত!
গল্পে চিনি কেন্দ্রীয় চরিত্রটির প্রতি সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার করা হয়েছে, তবে মিষ্টি পঞ্চাশের দশকে একজন যত্নবান মায়ের অভিনয় করেছেন - এমন এক মহিলা যাকে মনে হয় তার আপত্তিজনক স্বামীর মৃত্যুর পরে তার শোক তাকে ডানা গজিয়ে দিয়েছিলো ।নিজের মতন করে বাঁচতে শিখিয়ে ছিলো, নিজ পায়ে দাঁড়াতে শিখিয়ে ছিলো, শোক-ভয় কাটিয়ে সামনে এগুতে শিখেয়েছিলো।
মৈনাকের গল্পের লাইনে স্পষ্ট, যা সহস্রাবর্ষের প্রতিটি কিছু এবং সামনের কয়েক প্রজন্মের এক ভারসাম্যপূর্ণ মিশ্রণ। যদিও চিনি একটি 'বিংশ শতাব্দীর মহিলা' যিনি নিজের পায়ে দাঁড়িয়েই এই লড়ায়ে লড়াই করছেন, দাবি পেশা পরিচালনা করছেন, তার সম্পর্কের জন্য সময় নিচ্ছেন এবং বছরের পর বছর ধরে তৈরি ব্যক্তিগত অসুরদের সাথে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। অদৃশ্য পরিবারে বেড়ে ওঠা, সুদীপ আরও রক্ষণশীল এবং একটি স্থিতিশীল স্বপ্ন দেখছেন তাদের নিজস্ব বাচ্চাদের সাথে সম্পর্ক এবং পরিবার নিয়ে। তবে, চিনি এবং মিষ্টির মধ্যে একটি বিশাল অস্তিত্ব রয়েছে, যদিও উভয় মহিলাই একটি সাধারণ অতীত দ্বারা নির্মিত অদৃশ্য এর বিরুদ্ধে লড়াই করে চলছিল। এই নাটকটি যে ছবিতে আধিপত্য বিস্তার করে, ডললপ অফ হিউমার নিয়ে। এটি আসলে হিউমার যা ফিল্মে সেই সঠিক ভারসাম্য যুক্ত করে, অন্যথায় এর চেয়ে বরং গুরুতর ভিত্তি রয়েছে। এবং এটি অপরাজিতা যে এক জায়গায় জ্বলজ্বল করে। ভাড়াটিয়ার সাথে মৌখিক তর্ক করার জন্য যখন হাস্যকর এক-লাইনার সরবরাহ করার কথা আসে তখন তিনি সমস্ত তরল বক্তৃতা হন। যদিও সৌরভ পর্দায় দুই মহিলার দ্বারা কিছুটা ছাপিয়ে গেছে, তবে তিনি কিছু দুর্দান্ত আলোকীক অভিনয় করে নিজের পক্ষে দাঁড় করিয়েছেন। এটি দুটি তন্ত্রম রাণীর সম্পূর্ণ বিপরীতে তাকে দাঁড়াতে সহায়তা করে।
প্রযুক্তিগতভাবে বলতে গেলে, চলচ্চিত্রটি একটি দুর্দান্ত ঘড়ি কারণ ক্যামেরা তীব্র নাটকসহ দৃশ্যে প্রতিটি অভিব্যক্তি ধরতে পরিচালিত করে। চরিত্রগুলি এবং তাদের মেজাজ এবং আবেগগুলি শুরু থেকে শেষ অবধি ক্যামেরার ফোকাস পায়। একটি আন্তঃব্যক্তিক উদ্বেগ পিতামাতা এবং সন্তানের প্রেমের গল্পটি গ্রহণ করে। সামগ্রিকভাবে, “চিনি” সমস্ত বয়সের একটি পারিবারিক নাটক; যা একটি খুব বিনোদনমূলক প্যাকেজও।
“জেনারেশন আমি” - যে অপ্রতিরোধ্য প্রেম পেয়েছে তা দেখে আমি চলচ্চিত্র নির্মাণের এই পথে এগিয়ে যেতে চেয়েছিলাম যা গল্পের একান্ত ব্যক্তিগত জায়গা থেকে আসে যা আমার মনে হয় যে আমার সত্যিই বলা দরকার। তবে চিনি সম্পর্কে ধারণাটি এখান থেকেই আসা হয়তো। তবে দুটো কাহিনিই যেনো মন ছুঁয়ে যাওয়া এক অনবদ্য কাহিনিপট। বাঙ্গালী পরিবারের পারিবারিক কলহকে ঘিড়ে ,সেটাকে কাটিয়ে উঠতে পারার কাহিনি আবার সেটাকে ভুলে গিয়ে নতুন করে বাঁচার কাহিনি।
এই রোমান্টিক প্রেমের গল্পটিতে মধুমিতার চরিত্রটি ঘরোয়া বিষয়গুলির একটি পণ্য হিসাবে একটি চরিত্রের ভূমিকা ছিল, এটি টিকিং টাইম বোমার মতো। তিনি তার নিজের পেন্ট-আপ শক্তি এবং অভিনয় অনুভূতি পেয়েছেন। আমার কাছে যা সত্যই আকর্ষণীয় ছিল তা ছিল তাদের রসায়ন। মা এবং কন্যার কলহ-বিবাদ এবং দুটি ভিন্ন বক্তৃতার ধরণ এবং প্রজন্মের পার্থক্যগুলি প্রকাশ করেছেন। প্রথম থেকেই অপাদি (অপরাজিতা আধ্যা) এবং মধুমিতা সরকার সেই দুই ব্যক্তি ছিলেন যারা সবসময় মা এবং মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করতে যাচ্ছিলেন।তবে সৌরভ দাস এবং মধুমিতার এক দম্পতির সেই রসায়ন থাকা দরকার যেখানে লোকটি প্রচুর ধৈর্য ধরে সম্পর্কের দিকে ঝুঁকছে। এই বিষয়টি যে অপাদি এবং মধুমিতা একে অপরকে ভালভাবে জানেন না, আমার পক্ষে কাজ করেছিলেন কারণ দূরত্ব দুটি অভিনেতার মধ্যে জায়গা তৈরিতে অনেক সহায়তা করেছিল। সৌরভের কাজ তারিফের সামিল। সমস্ত চরিত্র এবং তাদের ইস্যুগুলির মধ্যে তিনি রেফারি থার্মোস্ট্যাট অভিনয় করেছিলেন যিনি সবাইকে ভারসাম্যপূর্ণ করেছিলেন। পিংকি ব্যানার্জি, যিনি ঘরের সহায়তা, বেলা মাশি চরিত্রে অভিনয় করেছেন, অসম্ভব ভালো কাজ করেছেন। সবার মাঝের মিলন সেতু রূপে ভালো মানিয়ে নিয়েছিলেন তিনি।
তাহলে আমি চিনি থেকে কী আশা করব? এটি একটি অনুভূতি-ভাল চলচ্চিত্র যা আমি বিশ্বাস করি যে কোনও স্তরের প্রত্যেকেই এর সাথে সংযুক্ত হয়ে সনাক্ত করবে। এটি প্রতিটি পিতা-মাতার এবং সন্তানের গল্প। এটি আমাদের মায়েদের আমাদের জীবনে যে ভূমিকা পালন করে তা বড় হওয়ার এবং বোঝার গল্প। এই ফিল্মটি প্রেমের ব্যক্তিগত শ্রম ছিল এবং এটিই সেই ভালবাসা যা আমি দর্শকদের কাছে উপহার দেওয়ার আশা করি। আমি বিশ্বাস করি যে ছবিটি দর্শকদের সন্ধান করবে তবে কখন এবং কোথায় তা চিন্তা করার এখন সেরা সময় নয়। এই ছুটির মরসুমে আমি আশা করি চেনি থেকে মানুষের ভালোবাসা মানুষের মধ্যে বহন করে, কারণ পরিবারই সবকিছু এবং পুত্র, কন্যা, পিতামাতা ও মায়েদের মধ্যে বন্ধন আসলেই গুরুত্বপূর্ণ। আগের তুলনায় এখন আমাদের সকলকে আমাদের বাবা-মাকে দেখাশোনা করা দরকার।
"চিনি” গল্পটি আসলে এক পারিবারিক কলহ থেকে বেড়িয়ে নিজেকে প্রমানিত করার চেষ্টা করতে থাকা মা-মেয়ের কাহিনী। শুধু তা নয়, বরং ফেলে আসা দিনগুলো মনে করে অতীতে হারিয়ে যাওয়ার গল্প।পরিবারকে নতুন করে জানার,বোঝার চিত্র দেখা যাবে এবং একটা সম্পর্ক কি করে সুন্দর করা যায়, সেটা নিয়ে ভাবা; সেটা নিয়েই যে বেঁচে থাকা সেটা নিয়েই সামনে এগিয়ে যাওয়ার যে প্রশান্তি তার এক অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে বেশ ভালভাবেই।সম্পর্ক নষ্ট করেও যে মানসিক সুখ হয় না,তাই শিখিয়ে দেয় এই চলচ্চিত্র।বাঁচতে হলে যে প্রেম-ভালবাসারও দরকার তা যেনো হাতেকলমেই শিখিয়ে দিয়ে চলতে থাকে গল্পের কাহিনি পট।
গল্পটি চলছিল নতুন-পুরোনো সম্পর্কের যাত্রা হয়ে।আমি বলব সংসার জীবনে সকলেরই এই চলচ্চিত্রটি দেখা দরকার,সম্পর্কের কোথায় কেমন করে সামাল দিতে হয় বা আমাদের কোথায় একটু ভাবা উচিত সেটার অভিপ্রায় শিখিয়েই চলতে থাকা এই গল্পটি - “চিনি ” । আপনার সময় নষ্ট হবে না বরং আপনার শেখার - জানার কিছু মূহুর্ত হবে।চলচ্চিত্রটি দেখুন, না হয় প্রিয় মানুষটার সাথেই দেখুন, অবশ্যই ভালো লাগবে। আশা করি আপনি মুভিটি দেখবেন।
0 মন্তব্যসমূহ