জোবায়ের রাজু
জামিল সাহেবের তিন মেয়ে। পারু, ছন্দা আর চিত্রা। অগাধ সম্পত্তির মালিক জামিল সাহেব। বিশাল আলিশান বাড়ি। কোন পুত্র সন্তান নেই তার। বড় মেয়ে পারুর জন্মের তের বছর পর জামিল সাহেব যমজ সন্তানের মুখ দেখলেন। ছন্দার দশ মিনিটের ছোট চিত্রা। জামিল সাহেবের স্ত্রী মাজেদা বেগম দু সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা নড়তে নড়তে বেঁচে গেলেন।
মায়ের পাশাপাশি বড় বোন পারুর আদর সোহাগেও বড় হতে থাকে ছন্দা আর চিত্রা। এক সময় পারুর জীবনে ভালোবাসার রং ছড়াতে আসে রায়হান। অতি সাধারণ ঘরের ছেলে সে। কিন্তু সাধারণ ঘরের এই ছেলেটাকে কি অসাধারণই না করে ভালোবেসেছে পারু। যে কারণে সে সব কিছু ফেলে রায়হানের নিন্মবিত্ত সংসারে চলে আসে।
মেয়েকে অন্য রকম ভালোবাসতেন বলে হয়তো জামিল সাহেব পারুর এমন কর্মকান্ড সহজে মেনে নিলেন না। পারুর প্রতি তার রাগ ক্ষোভ দিন দিন গাঢ় হতে থাকে।
যে সুখের আশায় রায়হানের সাধারণ জীবনে চিরদিনের জন্য চলে আসে পারু, সে সুখ কি সত্যিকার অর্থে ধরা দিয়েছে পারুর জীবনে? না দেয়নি। রায়হানের সংসারের নিত্যদিনের অভাবের মুখোমুখি হতে হতে হঁাপিয়ে উঠে পারু। অথচ ‘অভাব’ কি জিনিস, বাবার সংসারে কখনোই তার মুখও দেখেনি সে।
দু বেলা পেটে ভাত না পড়লেও এই কষ্টময় জীবনেও বাবার কথা, মায়ের কথা, আর দু বোনের কথা বেজায় মনে পড়ত পারুর। স্মৃতিকাতরতায় ভুগতে ভুগতে অনেক রাত যে ভোর হয়েছে, সে হিসাবও নেহাৎ কম নয়। ছন্দা আর চিত্রাকে কারণে অকারণে মনে পড়ত পারুর।
রায়হানের কাছে যখন চলে আসে পারু, ছন্দা আর চিত্রা তখন হাইস্কুল জীবনে পা রেখেছে কেবল। এতদিনে নিশ্চয় ওরা দুজন কলেজে উঠে গেছে! ছোট বেলায় পারু কঁাধে কঁাধে রাখত দু বোনকে। রুপকথার গল্প শোনার প্রবণতা ছিল চিত্রার। কত রাত যে পারু দু বোনকে ভুত প্রেতের গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়েছে। বড় বোনের কাছেই ছন্দা আর চিত্রার পড়ালেখার হাতেখড়ি। পারু বেশ দক্ষ ভূমিকায় দু বোনকে নামতা শিখিয়েছে, পরিচয় করিয়ে দিয়েছে স্বরবর্ণ আর ব্যাঞ্জনবর্ণের সাথে। যোগ বিয়োগ অংকগুলিও সহজ করে শিখিয়ে দিয়েছে। জামিল সাহেব মাঝে মাঝে মেয়ে পারুকে বলতো ‘তোর মাও তো ওদরে এতটা সেবা যত্ন করে না, যতটা করিস তুই।’ মিষ্টি হেসে পারু বলতো ‘ওরা আমার দুই কিডনি বাবা।’ জামিল সাহেব পারুকে আশীর্বাদ করতেন।
সব কিছু ফেলে সেই যে পারু চলে এসেছে রায়হানের এখানে, আজো দু বোনের স্মৃতি তাকে তাড়া করে। খুব দেখতে ইচ্ছে করে ছন্দা আর চিত্রাকে। কিন্তু কোন মুখে তাদের সামনে দঁাড়াবে পারু! তারা যদি জানতে চায় তাদের দুলা ভাই কি করে, জীবিকা কি, তখন পারু কিভাবে বলবে যে রায়হান বাজারের সামান্য একজন মুচি। পরের জুতা সেলাই করাই তার পেশা। বোনেরা তাদের দুলা ভায়ের এই পরিচয় শুনে হাসবে না করুণা করবে, ভেবে পায় না পারু।
রায়হানের সংসারে এসে অভাবের দাবানলে পুঁড়তে পুঁড়তে পারু আজকাল ভিক্ষা বৃত্তিতেও নেমে পড়েছে। যে ভিক্ষা বৃত্তি পেশাকে সারা জীবন সে নিন্দা করেছে, নিয়তির অদ্ভুত পরিহাসে আজ সে নিন্দিত পেশাকেই...! বোরকায় চেহারা আর সর্বাঙ্গ ডেকে ইদানিং ভিক্ষার থলে হাতে নিয়ে পথে নেমে পড়ে পারু। না, ভিক্ষা বৃত্তিকে এখন আর নিন্দা করে না পারু। স্বামী রায়হান দিন দিন অসুস্থ হয়ে উঠেছে। তার শ্বাসকষ্ট। ঔষুধ পত্র কেনার জন্যে আজকাল ভিক্ষা করতে হয়। রায়হানের জন্য সে সব করতে রাজী। এমন কি জীবন দিতেও।
ভিক্ষার অভিজ্ঞতা থেকে পারু শিক্ষা নিয়েছে এ সমাজে ভিখারিদের জন্য কারো কোন করুণা নেই। দয়া মায়ার তো প্রশ্নই আসে না। যারাই দু চার পয়সা দান করেন, তারা অহেতুক গালমন্দ শোনান। কিন্তু সেসব গায়ে মাখে না পারু। রায়হানের জন্য একটা ইনহেলার কেনা যে তার বড় জরুরি।
২.
সেদিন এলিফ্যান্ট রোডে ছন্দা আর চিত্রার সাথে দেখা পারুর। বোরকা আবৃত পারুকে প্রথমে চিনতে পারে না ছন্দা আর চিত্রা। তারা ব্যাগ ভর্তি প্রসাধণী নিয়ে আলো ঝলমলে এক কসমেটিস শপ থেকে বের হচ্ছিল। পারু তাদের কাছে হাত পাততেই আবিষ্কার করে এরা তার আদরের দু বোন। অনেক বছর পর দু বোনকে দেখে আনন্দে গলে উঠে পারু। মায়া ঝরা কণ্ঠে বলল ‘ওমা তোরা! বড় হয়েছিস তো অনেকটা। ভারি সুন্দর লাগছে।’ ছন্দা আর চিত্রা অবাক হয়ে বলল ‘আমাদেরকে কিছু বলছেন?’ পারু মুখ থেকে বোরকার নেকাব খুলতেই টাশকি খেল ছন্দা আর চিত্রা। ‘কেমন আছিস তোরা? মা কেমন আছে? বাবার শরীরটা ভালো? তোরা এবার কিসে পড়িস?’ পারুর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ছন্দা বলল ‘তুই? তোর এই হাল কেন? হাতে এটা থলে নাকি? ভিক্ষা করিস?’ পারু মলিন গলায় বলল ‘হঁ্যারে, তোদের দুলা ভায়ের চিকিৎসার খরচ চালাতে আমাকে ভিক্ষা করতে হয়!’ চিত্রা ফিসফিস করে বলল ‘আস্তে বলতো আপা। তুই আমাদের বোন, তুই ভিক্ষা করিস, এটা জানলে লোকে আমাদের লজ্জা দেবে না? এ মার্কেটের সব ব্যবসায়ী আমাদেরকে চিনে।’ পারু চিত্রার কথা শুনে কি জবাব দিবে, ভেবে পেল না। ছন্দা তড়িগড়ি করে বলল ‘আপা, আরেকটু দূরে গিয়ে দঁাড়া তো। তোর শরীর থেকে বিশ্রী গন্ধ আসছে। চলে যা তুই। তোর শরীরে আমাদের রক্ত বইছে, এটা এখানের কেউ জেনে গেলে ভারি লজ্জা হবে আমাদের।’ দু বোনের কথা শুনে স্তব্দ হয়ে গেল পারু। ছন্দা তার ব্যাগ থেকে এক হাজার টাকার একটি নোট বের করে পারুর ভিক্ষার থলিতে রেখে বলল ‘এখান থেকে যা আপা। আমরাও যাচ্ছি। এখনো কেউ টের পায়নি। তুই আমাদের বোন, ভিক্ষা করিস, এটা কেউ টের পেলে আমরা বড় লজ্জা পাবো। আমাদের বোন ভিক্ষা করে! ছিঃ!’
দ্রুত পায়ে ছন্দা আর চিত্রা স্থান ত্যাগ করল। ভিজে আসা চোখে বোনদের চলে যাওয়া দেখল পারু। এরাই তার সে বোন, ছোট বেলায় যাদেরকে সে ভালোবাসা বিলিয়ে দেবার কোন ত্রুটি রাখেনি। ভাবতে গিয়ে পারুর চোখের দু ফেঁাটা জল গড়িয়ে পড়ল হাতের থলিতে ছন্দার দেয়া এক হাজার টাকার নোটটির উপর। পাশে থেকে এক দোকানদার পারুকে ডেকে বলল ‘আজ তোর ভাগ্য ভালো। এক হাজার পেয়েছিস। ওরা ধনীর দুলালি দু বোন।’ পারুর গলা ফাটিয়ে বলতে ইচ্ছে করল ‘আমিও ওদের বোন। ছোট বেলায় ওদেরকে কোলে পিঠে রেখে বড় করা বোন আমি। ভাগ্য আজ আমাকে পথে নামিয়েছে।’
পারুর মনে হল কে যেন অদৃশ্যে তার গলা চেপে ধরেছে। তাই কথাগুলি আর বলা হল না। কেবল গলার ভিতরে এক পশরা কান্না এসে আটকে রইল।
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী।
0 মন্তব্যসমূহ