সর্বশেষ

10/সর্বশেষ/ticker-posts

অপরিচিতা


 
বিকেল চারটা বাজতে না বাজতে আমার চোখে দারুন ঘুম আসে। চেষ্টা করেও চোখ খোলা রাখতে পারি না এমন অবস্থা ৷ চোখ না বুজলে আবার চোখ কড়কড়ে হয়ে যায়। চোখ থেকে পানি বের হয়। সেদিন আমার রুমমেট আব্বাস সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,'আরে ভাই! কাঁদছেন নাকি? কি হয়েছে কোন সমস্যা থাকলে বলুন তো। আমি দেখবো!' আব্বাস সাহেবের মুখের উপর ধমকের সুরে বলি, 'কাঁদছি না ভাই। ঘুম ঘুম পাচ্ছে কিন্তু ঘুমাচ্ছি না। তাই চোখ থেকে পানি পড়ছে। আব্বাস সাহেব,'ও আচ্ছা বলে সিগারেট ধরালেন। ' আজও এমন হচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়লাম। ঠিক ঘুমিয়ে না,ঘুম জাগরনের মাঝামাঝি সময়ে৷ এই সময় বালিশের নিচে থাকা ফোনটা কেঁপে উঠলো । বিরক্ত চোখ না খুলে হাতরে হাতরে ফোন খুজে বের করলাম বালিশের নীচ থেকে৷ দারুন অসহ্য লাগছে। কানে লাগিয়ে ফোন ধরে বললাম, 'হ্যালো!' ওপাশ থেকে একজন বলল,'একটা মেয়ে গাড়ির সাথে এক্সিডেন্ট করেছে৷তার মোবাইলের কল লিস্টে আপনার নাম্বারটি শেষবার ডায়েল করা হয়েছিলো ' তারপর হাসপাতালের ঠিকানা দিয়ে আমাকে জলদি হাসপাতালে যেতে বলল।আমি লোকটাকে ঠিকানা জিজ্ঞেস করারো সময় পেলাম না৷ কৌতূহলী হয়ে আবার ফোন দিলাম। তিনি বললেন রোগীর কন্ডিশন খুব একটা ভালো না৷ মাথা ফেটে প্রচুর রক্তক্ষরণ  হয়েছে।রোগী এখন অজ্ঞান। এই মূহূর্তে রোগীর নাম  জানা সম্ভব নয়। আমি খানিকটা বিরক্ত হলাম। ধ্যাত বলে মোবাইলটা ছুড়লাম টেবিলে।আবার ভাবলাম হয়ত আমার কাছের কেউ হবে। কিন্তু এ শহরে তো আমার কেউ কাছের নেই৷ একটু বিভ্রান্ত হলাম। ভাবলাম বিষয়টা আব্বাস সাহেবকে শেয়ার করা যায় কি না। 

২.
আমি এখন দাঁড়িয়ে আছি হাসপাতালের করিডোর। চারদিকে মানুষজন ছোটাছুটি করছে। নার্সরা ছুটছে৷ কেবিন বয় ছুটছে স্ট্রেচার নিয়ে। হঠাৎ হাউ মাউ করে কান্নার আওয়াজ শুরু হচ্ছে। আবার কেউ কেউ মিষ্টি নিয়ে ছুটছে৷হাসপাতাল মন ভালো খারাপের একটা জায়গা!

যে মেয়েটি গাড়ির সাথে এক্সিডেন্ট করে এখন অপারেশন থিয়েটারে ক্রিটিকাল সিচুয়েশনে আছে।  তার সাথে আগে কখনো দেখা হয়নি আমার৷ এই মেয়ের কল লিস্টে আমার নাম্বার কোত্থেকে এলো কে জানে৷ খানিকটা বিচলীত হলাম। ডাক্তার সাহেব আমার হাতে মেয়েটির ফোনটি ধরিয়ে দিয়েছেন।খুব দামী ফোন,এক্সিডেন্ট করার সময় ফোনটি বোধয় মেয়েটির হাতেছিলো। ফোনের স্ক্রিন ফেটে একাকার হয়ে গিয়েছে। ফোনে লক করা নেই। দেখে নতুন ফোনই মনে হচ্ছে। কন্টাক্ট লিস্ট চেক করলাম মেয়েটির। কল লিস্টে আমার নম্বরটিও  আছে। ফিরে গেলাম দুপুর বেলায়,দুপুর বেলা যখন বাথরুমে জামাকাপড় ধুচ্ছিলাম তখন আব্বাস সাহেব চেচিয়ে উঠে বলেছিলেন,'নিলয় ভাই! ফোন বাজছে আপনার। 'আমি বলেছিলাম,'দেখুন তো কে! ' তিনি বলেছিলেন,'কোন নামনেই শুধু নম্বর থেকে ফোন এসেছে৷ ' আমি বলেছিলাম,'তাহলে রেখে দিন।'

ভাবনা থেকে সম্ভ্রম ফিরলো নার্সের ডাকে।নার্স বলল এই মুহূর্তে রোগীর রক্ত লাগবে। আমি চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে রইলাম।নার্সকে বললাম,'রক্তের গ্রুপ কি?' নার্স বলল, 'বি পজেটিভ। '  কেন জানি একটা স্বস্তি ফিরে আসলো মনে, 'আমার রক্তের গ্রুপও বি পজেটিভ। '

সর্বমোট রক্ত লাগলো চার ব্যাগ। আমি এক ব্যগ দিলাম। আমার রুমমেট আব্বাস সাহেব একাই দিলেন দুই ব্যগ। আর তার বন্ধু এক ব্যাগ। আব্বাস সাহেবকে সব খুলে বললাম। তিনি উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠলো,'আরে ভাই আপনিতো সিনেমার গল্পকেও হার মানিয়ে ফেলেছেন। ' আমি হাসতে হাসতে বললাম সিনেমা কোথায় পেলেন এখানে?' তিনি বললেন, 'এসব ঘটনা সিনেমা ছাড়া ঘটে নাকি?' আমি হাসলাম। 

৩.
মেয়েটির জ্ঞান ফিরলো দুদিন পরে। হাসপাতালের করিডোরে বেঞ্চে বসেছিলাম। নার্স ছুটতে ছুটতে এসে বলল,'রোগীর জ্ঞান ফিরেছে। ' আমি নার্সের সাথে ছুটলাম। 

যেটা নিয়ে মনে মনে ভয় পাচ্ছিলাম। মেয়েটির জ্ঞান ফিরলে আবার স্মৃতি শক্তি না হারিয়ে ফেলে। উদ্ধার করা লোকটির বর্ননা মতে খুব খারাপ ভাবে দূর্ঘটনার স্বীকার হয়েছিলো মেয়েটি।

রাস্তা পার হচ্ছিলো মেয়েটি। ছুটে আসা একটি মাইক্রোবাস ধাক্কা দেয় মেয়েটিকে। মেয়েটি ছিটকে পরে যায় খানিকটা দূরে। লোকজন উদ্ধার করে। মেয়েটির মোবাইলটি পায় একজন। সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ফোন দেয় একজন।কিন্তু এর মধ্যে আমার যোগসূত্রতা কোথায় সেটা জানি না এখনো। 

মেয়েটি আমাকে দেখে খানিকটা বিচলিত হলো। এই প্রথম দেখলাম মেয়েটিকে। আহা! বেচারীর অবস্থা দেখে মায়া লাগলো আমার। চোখ দেবে গিয়েছে। চোখের নিচে কালী পড়েছে। মাথায় শাদা ব্যান্ডেজ।তাতে যেন সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে মেয়েটির।  মেয়েটি আমাকে দেখেই কাতর গলায় বলল,'আপনি কে?' আমি সব খুলে বললাম তাকে। মেয়েটি তার ফোনটি চাইলো। কিন্তু সেটায় চার্জ না থাকার কারনে আমার ফোনটা এগিয়ে দিলাম। 

 মেয়েটি বাসা থেকে পালিয়ে এসেছিলো। মেয়েটি ধনী পরিবারের।সে এক প্রকারের বন্দী জীবন জাপন করছিলোই বলা যায়। পরিবারের কঠিন শাসনের মধ্যে নিজেকে জেলখানার বন্দী আসামী মনে হতো তার। এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয় বাসা থেকে পালানোর। বাসা থেকে পালিয়ে তার বান্ধবীর বাসায় যাচ্ছিলো সে। সেখান থেকে তার কক্সবাজার তারপর সেন্টমার্টিন যাওয়ার কথা ছিলো।বাসা থেকে বেরিয়ে ফোনের সিমকার্ডটা খুলে রাখে সে। ভুল বশত নম্বরগুলো ফোনে কপি করে রাখতেও ভুলে যায়। এক পর্যায়ে তার বন্ধবীকে ফোন দেয়। কারন তার বান্ধবীর নম্বর তার মুখস্ত ছিলো। কিন্তু মাঝখানের একটি সংখ্যায় ভুল হওয়ার কারনে ফোন চলে আসে আমার কাছে। 

৪.
সাতদিন পরে মেয়েটি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলো।বাসায় এসে বুঝতে পারলাম মেয়েটির প্রেমে পড়ে গিয়েছি আমি।

পাঁচ বছর পরের ঘটনা,'নীলা বেলকুনিতে বসে বসে আকাশ দেখছিলো। আমি বেলকুনিতে উকি দিলাম। গোধূলীর লাল আভায় নীলার মুখটা আরো সুন্দর নীলা চায়ে চুমক দিচ্ছিলো। চায়ের কাপ ওঠা নামা করছে তার মুখে। এই মেয়েটিকে আমি দারুন ভালোবাসি। মাঝেমধ্যে মেয়েটির পাগলামো ভালোই লাগে আমার। এই মেয়েটি আমার জীবনে এসেছিলো একটা ট্রাজেডি দিয়ে।পাচ বছর ধরে এই মেয়েটি আমার সাথে ছায়ার মতো পাশে।আমার সুখে দুঃখের ভাগ বসিয়েছে। আমি তাকে ভালোবাসি!আমি তাকে ভালোবাসি আমার জীবনের থেকেও বেশি করে। সে কি জানে? কে  জানে!


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ