সর্বশেষ

10/সর্বশেষ/ticker-posts

প্রবন্ধ-যুগের দাবিতেইঃ মাইকেল মধুসূদন মহাকবি হয়েছিলেন

 

ডঃসুবীর মণ্ডল

উনবিংশ শতকে বাংলা নবজাগরণের শ্রেষ্ঠ পুরোহিত মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা কাব্য  সাহিত্যে প্রকৃত পক্ষে আধুনিক যুগের সৃষ্টি করলেন,অনন্য সাধারণ বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন  মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনি সমকাল দ্বারা বন্দিত এবং ভাবিকাল দ্বারা প্রসংশিত এক বর্ণনয় বহুকৌণিক ব্যক্তিত্ব।বাংলা নবজাগরণের জোয়ারে প্রাচীন ধারার পুনমূর্ল্যায়নের যুগে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের অসামান্য কবি প্রতিভাতেই বাংলা কাব্য তার যুগোচিত রূপটি বিকশিত করে উঠল।মানবতাবাদী কবি কাব্যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ভাবধারার এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটল।এ-এক পরমপ্রাপ্তি।

  (১) উনবিংশ শতকে বাংলার জাগরণের অন্যতম অগ্রদূত এবং শ্রেষ্ঠ কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত একদিকে যেমন ছিলেন হোমার, ভার্জিল ও মিলটনের বর্ণময় কাব্যের গভীর অনুরাগী, তেমন কালিদাস-ভবভূতি প্রভৃতি প্রাচ্য কবিদের রচনার সঙ্গেও ছিল তাঁর নিবিড় যোগাযোগ।অসাধারণ কবি প্রতিভার অধিকারী মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রথম যৌবন থেকেই মহাকবি হবার স্বপ্ন দেখেছিলেন, মেঘনাদ বধ কাব্যের সূচনাতেই কবি  আপন অভিপ্রায়টি প্রকাশ করে বলেছিলেন--'গাইবা মা   বীররসে ভাসি মহাগীতি,' অর্থাৎ বীররস প্রধান মহাকাব্য রচনাই তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। আপন সৃজনশীল কবি  প্রতিভার উপর ছিল তাঁর সুগভীর আস্হ,তাই রামায়ণের পটভূমিকা অবলম্বন করেই নিজের   অমিত্রাক্ষর ছন্দে 'তিলোত্তমা সম্ভবের' কবি রচনা করেলেন তাঁর অমর সৃষ্টি 'মেঘনাদবধ কাব্য '। রামায়ণের কাহিনী অনুসরণ প্রসঙ্গে তিনি  একটি চিঠিতে রাজ নারায়ণ বসুকে লিখেছিলেন--'I love the grand mythology of our ancestors.  It is full of poetry. A fellow with an inventive brain can manufacture the most beautiful out of it.'
 
(২) মাইকেল মধুসূদন দত্তের সৃজনশীল কবি প্রতিভার অসাধারণত্ব সম্পর্কে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু তাঁর মধ্যে ছিল যে রোমান্টিক কবির গীতি প্রবণতার লক্ষণ তা সহজেই বোঝা যায়। তাঁর  আত্মবিলাপ কবিতাটিতে, অনেকের মতে,বাংলা গীতিকাব্যের প্রথম সার্থক প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। মধুসূদনের চতুর্দশ পদী কবিতাবলীতেও এই লক্ষণ বিশেষ ভাবে ফুটে উঠতে  দেখা যায়। তাঁর অনেক রচনাতেও ব্যক্তিগত আশা-আকাঙ্খা তীব্র  সংবেদনশীলতায় পূর্ণ হয়ে অপূর্ব কাব্যরূপ লাভ করেছে।তাঁর কবিত্বের প্রবনতা যে লিরিকের দিকেই ছিল মেঘনাদবধ কাব্যেই তার অভ্রান্ত প্রমাণ নিহিত রয়েছে। 

(৩)উনবিংশ শতকে,বাংলা সংস্কৃতির নবজাগরণে র উষাকালে যখন নতুন ধ্যানধারণার উন্মেষ ঘটেছিল তখন তার প্রতিফলন ঘটেছে সমকালীন বাংলা কাব্য, নাটক, উপন্যাস প্রভৃতিতে। মধুসূদন  নব মানবতার প্রতিষ্ঠায় যুগের দাবিতেই মহাকাব্য রচনায় ব্রতী হন।মেঘনাদবধ কাব্য  প্রসঙ্গে মোহিত লাল মজুমদার বলেছেন--'উনবিংশ শতাব্দীর কবির পক্ষে, বিশেষত বাঙালির পক্ষে, মহাকাব্যের প্রেরণা রক্ষা করা সম্ভব ছিল না। মহাকাব্যের কবির পক্ষে যে শান্ত সংযত রসাবেশ--দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও সংশয়হীন চিত্তস্ফূর্তির প্রয়োজন,তাহাই মধুসূদনের সজ্ঞান কামনা   হইলেও, তিনি তাঁহার ব্যক্তিচেতনার অন্তস্হলে তাহা অনুভব করেন নাই।মহাকাব্যের কবির অতি সরল ও সহজ বীররস প্রীতিই থে
কে--দেশ,জাতি বা ধর্মের গৌরব গান তাঁহার কাব্য স্ফূর্তির কারণ;---'

(৪)সাহিত্য সমালোচক মোহিত লাল মজুমদার আরো বলেছেন তাঁর  মনোভূমি সম্পর্কে, আলোচনার প্রেক্ষিতে অত্যন্ত তাৎপর্যময়--'মেঘনাদ বধের কবির চিত্তে একটা বড় দ্বিধা বা দ্বন্দ্ব ছিল--কবির মন যাহা চাহিয়াছিল, প্রাণ তাহা  স্বীকার করে নাই। তাই এপিক আকারের তলে তলে অন্তঃসলিল হইয়া লিরিকের ফল্গুস্রোত বহিয়াছে ।এই লিরিক সুর কবির সুপ্ত আত্মারই  ক্রন্দনধ্বনি ,ইহাকে নিবারণ করা কবির পক্ষে অসাধ্য ছিল।' আসলে মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্যের আদর্শ হলেও কবির প্রবৃত্তি ছিল  রোমান্টিক। রাবণের মমত্ববোধ ও বাৎসল্য প্রেমের প্রকাশে,রামের বিলাপে,সীতার করুণ কাহিনী বর্ণনায় এবং প্রমীলার সহমরণ যাত্রার করুণ দৃশ্যে কবি মধুসূদনের লিরিক সুরই প্রবল বেগে উৎসারিত হয়েছে।যেমন--"পঞ্চবটী বনে মোরা গোদাবরী তটে
ছিনু সুখে,হায় সখি,কেমনে বর্ণিত
সে কান্তার কান্তি আমি?"এ ঠিক যেন গীতিকাব্যেরই ভাষা। অনুরূপ ভাবে সারা কাব্যটির বিভিন্ন  স্হানে দেখা যায় কবির নিজ প্রাণের উচ্ছ্বাস ও ভাবকল্পনার প্রকাশ ঘটেছে, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

"স্নান করি সিন্ধুনীরে রক্ষোদল এব
ফিরিলা লঙ্কার পানে,"
শেষ কথা: নবজাগরণের অন্যতম প্রধান ঋত্বিক পুরুষ মাইকেল মধুসূদন দত্ত যুগের দাবিতে মহাকবি হয়েছিলেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন তাঁর বিরল সৃজনশীল প্রতিভার জন্য। 

বাঁকুড়া, পশ্চিমবঙ্গ ,ভারত ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ