মাইকেল মধুসূদন দত্ত – একটি দৃষ্টান্তমূলক ধারনা । এবং বিষয় । সাহিত্য সৃষ্টির দিক নির্দেশনার ক্ষেত্রে । জীবন যাপনের নিরিখেও। যা প্রকৃতপক্ষে আমূল পরিবর্তন - ‘প্যারাডাইম শিফট ( Paradigm shift ) ‘। কবি হবেন – এই গভীর প্রত্যয়ে ঘর ছাড়লেন । পরিবার , মানসম্মান , এমনকি ধর্মকেও । আর বাংলা ভাষা , সাহিত্য ও ‘ সাহিত্যের-বোধ ‘ , সাহিত্য-চিন্তার উপলব্ধি কে তুলে দিয়েছেন অতুল উচ্চতায় ।
জীবনের সময় সীমা মাত্র ৪৯ বছর ( ১৮২৪ – ১৮৭৩ ) । জীবন এঁকেছেন নিজের জেদে , বাসনায় , আনান্দ দুঃখ বেদনার রঙ তুলি দিয়ে । সেই উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলা নবজাগরণের যে দুরন্ত ঘূর্ণির সূচনা – রাজা রামমোহন রায় , সতীদাহ প্রথার নিষিদ্ধ , হিন্দু কলেজ , বাঙালী সমাজচেতনাকে ঝাঁকিয়ে দিচ্ছেন ডিরোজিও – তারই মাঝখানে এসে পড়েছেন যশোরের কপোতাক্ষ-তীরের সাগরদাঁড়ি গ্রামের মধুসূদন দত্ত ।
নিজের শর্তে জীবন কে যাপন করতে ক জন পেরেছেন ? মধুসূদনও পারেন নি । তা বলে ইচ্ছেটা মরে যায় নি । বড় কবি হওয়ার ইচ্ছে ছিল , হয়েছেন । আরামে বিলাসে জীবন কাটানোর ইচ্ছে ছিল – কিছুটা পেরেছেন । খ্রিস্টান হবার ইচ্ছে ছিল , হয়েছেন । সেই কারনে হিন্দু কলেজে পড়ার অধিকার হারালেন । মাইকেল পড়তে গেলেন হাওড়ার শিবপুরে বিশপ’স কলেজে । ঘরহারা , ঘরছাড়া – যশোর , কলকাতা , লন্ডন , ভারসাই থেকে শুরু করে প্রেম , পরিবার – সংসার । আর বিদ্যাসাগর ছাড়া তাঁর জীবনটাই অসম্পূর্ণ । সবটাই একটি দৃষ্টান্তমূলক । ‘প্যারাডাইম শিফট ( Paradigm shift ) ‘।
তেমনি মহান একটি দৃষ্টান্ত হল বাংলা সাহিত্যে মহাকাব্য রচনা । মহাকাব্য রচনার আকাঙ্খা তাঁর ছেলেবেলা থেকেই । সেই ইচ্ছের তাগিদে বাংলা কাব্য কে নতুন করে জন্ম দিলেন । নতুনের মড়কে উদ্ভাসিত করেছেন । প্রচণ্ড প্রতিভার জোরে মহাকাব্য সৃষ্টি করে বিশ্ব কে অবাক করে দিয়েছেন । সেই সময়ের বাংলা সাহিত্যে বীর রসের দৃষ্টান্ত ছিল না । একটিমাত্র চরিত্র ছিল – চাঁদ সদাগর । দৈবিক শক্তির কাছে মাথানত করানো হয়েছে । প্রকৃতপক্ষে তাতে বীরত্বের প্রাধান্য নেই । অথচ বীররসের প্রতি বাঙালীর নিবিড় আগ্রহ । ‘ মেঘনাদ বধ ‘ আধুনিক মহাকাব্য । অমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখা একটি মহাকাব্য । তাঁর শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সৃষ্টি বলে বিবেচিত হয় । বাংলা কাব্য সাহিত্যে একক সৃষ্টি । ক্লাসিক ও রোমান্টিকতার সমন্বয়ে । রাম তো মানুষ । আবার বিষ্ণুর অবতার । তাই রাম দেবতাও ।
কিন্তু মধুসূদনের রাবন – এক অপূর্ব মানুষ – ‘ Grand Fellow ‘ । পুত্র মেঘনাদের সহযোগিতায় রাবন ত্রিভুবন বিজয়ী সম্রাট । স্বর্গের দেবতারাও রাবনের ভয়ে ভীত । আবার শৌর্যের সংগে স্নেহময় পিতা । স্নেহ প্রেম বাৎসল্য আছে বলে রাবন অপূর্ব । স্বদেশ চেতনা ও জাতীয়তাবোধের চেতনাকে ধারন করে থাকেন । এই ‘ মেঘনাদ বধ ‘ কাব্যে রামের উপস্থিতি , শোচনীয় ভাবে পৌরুষহীন । একটি দুর্বল ও কোমল চরিত্রের । রাবন কে যথার্থ বীরের আসনে বসানো হয়েছে । রাবন কে দেখানো হয় একজন দেশভক্তি বীর হিসাবে । যিনি নিজের মাতৃভূমিকে বিদেশী আক্রমণকারীদের থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন । এইখানে বাল্মীকি রামায়ণের সংগে মেঘনাদ বধ কাব্যের আমূল পার্থক্য । দৃষ্টান্তমূলক উদাহারন । ‘প্যারাডাইম শিফট ( Paradigm shift ) ‘।
নিজের জীবনের মতই ‘ মেঘনাদ বধ ‘ কাব্য একইসঙ্গে বীররস ও করুন রসের মহাকাব্য । এই মহাকাব্যের শুরু বীরবাহুর মৃত্যু প্রসঙ্গ দিয়ে । দুঃসংবাদে রাবন শোকে মর্মাহত হয়েছেন ঠিকই । কিন্তু তিনি জানতে চেয়েছেন বীরবাহুর বীরগতির বর্ণনা । এই বীরগতির প্রাপ্তির অসাধারন বর্ণনা আছে মহাকাব্যের শুরুতেই । চিত্রাঙ্গদা পুত্রশোকে কাঁদতে কাঁদতে রাজসভায় এলেন । ‘ শোকের ঝড় বহিল সভাতে ‘ । কিন্তু পরক্ষনেই মেঘনাদের বীরোচিত উদ্দীপনা এবং লঙ্কায় এসে পিতার কাছে যুদ্ধযাত্রা ও যুদ্ধজয়ের অনুমতি প্রার্থনা – ‘ দুইবার আমি হারানু রাঘবে/ দেহ আজ্ঞা মোরে ; / দেখিব এবার বীর বাঁচে কি ঔষধে …’ । বীররসের প্রবাহ ।
মহাকাব্যের তৃতীয় সর্গের শুরু হয়েছে প্রমীলার চোখের জলে । ক্রুনার রসে । প্রমীলা কাঁদছে বিরহে । লঙ্কায় প্রবেশের সময়ে তার আচারনে ভাবনায় দীপ্ত হয়ে উঠেছে বীররস । ‘ দানবনন্দিনী আমি ; রক্ষকূল বধূ ; / রাবন শ্বশুর মম , মেঘনাদ স্বামী ; / আমি কি ডরাই , সখি ভিখারী রাঘবে …’ । কিংবা মায়ের অনুমতি নিতে মেঘনাদের নিবেদন , ‘ পাশিব সমরে আজি , নাশিব রাঘবে ‘ । নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে লক্ষন ও মেঘনাদের বাগযুদ্ধ , মেঘনাদের যুদ্ধনীতি বা কোষার আঘাতেই লক্ষনকে হতচেতন করার বর্ণনা । এই বীর রসাত্ত্বক বর্ণনার বিকল্প উদাহারন বাংলা সাহিত্যে নেই । বাঙালী মাত্রেই জানে , কি অন্যায় যুদ্ধে গুপ্তঘাতকের মতো ইন্দ্রজিৎ কে বধ করেছিলেন লক্ষন । সে অন্যায়ের ক্ষমা হয় না । লক্ষনের অজস্র গুন আছে । তবুও বাঙালী মননে লক্ষন কলঙ্কিত ।
মেঘনাদের মৃত্যু জনিত কারনে রাবনের মনের ব্যাকুলতা , কষ্টের বিবরণ – এই কাব্যের বেদনা বিধুর রস পরিণতি । এই পরিণতির আবেদন সুগভীর । মহাকাব্যের এই পর্বে দেখা যায় প্রতিপক্ষ রাম সীতা বিভীষণ – এমন কি মহাদেবেরও চিত্তবৈকল্য । একটি দৃষ্টান্তমূলক উদাহারন । মাইকেল বন্ধু রাজনারায়ণ কে একটি চিঠিতে লিখেছেন , ‘ I can tell you that you have to shed many a tear for the glorious Rakhasas and for poor Lakshman , for Promila , I never thought I was such a fellow of Pathetic .
মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ব্যাক্তি জীবনে হিন্দু ছিলেন , না মুসলিম , না কি খ্রিস্টান । সেটা বড় কথা নয় । তিনি একজন বাঙালী মানুষ । বাংলা তাঁর মাতৃভাষা । বাঙালী জাতীয়তাবোধ তাঁর বিশ্বাসের জায়গা । পৃথিবীর সব দেশে সব কালে প্রকৃত ভালো লেখকরা তাঁর সাহিত্যের মধ্যে স্বদেশ চেতনা ও জাতীয়তাবোধের চেতনাকে ধারন করে থাকেন । মধুসূদনের সমগ্র সাহিত্যে – কবিতা , নাটক , প্রহসন , মহাকাব্যে স্বদেশ চেতনা ও জাতীয়তাবোধের প্রকাশ পেয়েছে । বিশেষত ‘ মেঘনাদবধ কাব্য ‘ ভারতীয় এবং বাংলা সৌন্দর্য -চেতনা , জীবন ভাবনার অনুরুপ ও অনুকূল । একই সংগে বাংলা সাহিত্যে ইউরোপীয় চিন্তা ও চেতনার সার্থক প্রতিফলন ঘটান মাইকেল মধুসূদন দত্ত ।
0 মন্তব্যসমূহ