সর্বশেষ

10/সর্বশেষ/ticker-posts

চেরনোবিল; বিশ্বের ইতিহাসে ভয়ংকরতম পারমাণবিক দূর্ঘটনা।

 ২৬ এপ্রিল ১৯৮৬, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছোট একটি ভুল পরীক্ষা। অতঃপর সমগ্র বিশ্ব সাক্ষী হয়ে রইল ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ পারমাণবিক বিপর্যয়ের। হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত পারমাণবিক বোমার তুলনায় প্রায় ৪০০ গুন তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়েছিলো একটি পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দূর্ঘটনা। ইউক্রেনের চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ঘটে যাওয়া এই বিস্ফোরণ, কাঁপিয়ে দিয়েছিলো পুরো বিশ্বকে। রাতের আঁধারে শুরু হওয়া এই দুর্যোগের ছায়া আজও রয়ে গেছে সেই মৃত নগরীতে। কিভাবে সূত্রপাত হয়েছিলো এ বিষ্ফোরনের? এখন কেমন আছেন সেই শহরের বাসিন্দারা?

১৯৭৭ সালে বর্তমান ইউক্রেনের প্রিপিয়াত শহরে চেরনোবিল নামে একটি পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মান করে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকার৷ চারটি চুল্লীর মাঝে সর্বশেষ চুল্লীটি বসেছিলো ১৯৮৩ সালে। ৪ নম্বর চুল্লিতে দূর্ঘটনার দিন একটি নিরাপত্তা পরীক্ষা চলছিল। উদ্দেশ্য ছিল—বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হলে রিঅ্যাক্টর কীভাবে পরিচালিত হবে, তা পরীক্ষা করা। কিন্তু এই পরীক্ষার সময় একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরীক্ষার জন্য চুল্লীর কুলিং সিস্টেমটির বৈদ্যুতিক সাপ্লাই বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু সময়মত ব্যাকআপ জেনারেটর চালু না হওয়ায় খুব দ্রুত সময়ে চুল্লীর সমস্ত পানি বাষ্পীভূত হতে শুরু করে। এদিকে কর্মীরা ভুল করে গ্রাফাইট নিয়ন্ত্রিত রডগুলো সরিয়ে ফেলেছিলেন, যা পারমাণবিক বিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য অপরিহার্য ছিল। এর ফলে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, রিঅ্যাক্টরের অভ্যন্তরে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়, এবং এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। রাত ১:২৩ মিনিটে প্রথম বিস্ফোরণটি ঘটে, যা রিঅ্যাক্টরের বিশাল ঢাকনাটিকে উড়িয়ে দেয়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘটে দ্বিতীয় বিস্ফোরণ। যা পারমাণবিক বিক্রিয়ার ফলে তেজস্ক্রিয় ধোঁয়া ও কণা বাতাসে ছড়িয়ে দেয়। যেসব কর্মীরা আগুন নেভাতে ছুটে গিয়েছিলেন, তারা জানতেন না যে তারা মৃত্যুর মুখে চলে গেছেন। বিকিরণের মাত্রা এতটাই বেশি ছিল, যে অনেক দমকলকর্মী কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাদের কেউ কেউ পরদিন সকাল না হতেই মৃত্যুবরণ করেন।
 
 
যে ভুলের কারনে দূর্ঘটনার সূত্রপাত, তা কাটিয়ে উঠতেও চরমভাবে ব্যার্থ হয়েছিলো সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা৷ চেরনোবিলের সবচেয়ে কাছের শহর প্রিপিয়াত ছিলো দূর্ঘটনাস্থল থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে। এ শহরে বাস করতো প্রায় ৫০ হাজার বাসিন্দা। বিস্ফোরণের পরও প্রথম ২৪ ঘণ্টায় শহরের বাসিন্দাদের কিছুই জানানো হয়নি। শিশুরা স্কুলে গিয়েছিল, মানুষজন স্বাভাবিকভাবেই দিন কাটাচ্ছিলেন। অথচ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছিল প্রাণঘাতী তেজস্ক্রিয়তা। বাতাসে সিজিয়াম, আয়োডিন, ও স্ট্রনটিয়াম এর মত ভারী ধাতু ছড়িয়ে পড়ে।  ২৭ এপ্রিল দুপুরে বাসের বহর আসে, শহরের বাসিন্দাদের জানানো হয়, শহর খালি করা হবে, কিন্তু মাত্র কয়েক দিনের জন্য। মানুষজন তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছাড়াই বাসে উঠে পড়ে। তারা জানত না, প্রিপিয়াত শহরে আর কখনোই ফিরতে পারবে না। ইউক্রেন, বেলারুশ, রাশিয়া ছাড়িয়ে এই তেজস্ক্রিয় ধোঁয়া পুরো ইউরোপ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। পরবর্তী কয়েক বছরে হাজার হাজার মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হন, বিশেষ করে শিশুরা থাইরয়েড ক্যান্সারে ভুগতে শুরু করে। অনেক নবজাতক জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মায়।
 
চেরনোবিলে ঘটে যাওয়া এই দূর্ঘটনার দায় চাপানো হয় পরীক্ষার কাজে নিয়োজিত একদল প্রকৌশলীর উপর। বলা হয় এ পরীক্ষাটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করার আগেই সম্পন্ন করা উচিত ছিলো। কিন্তু এ দুর্ঘটনা শুধু কয়েকজন ব্যক্তির ভুল ছিল না। এটি সোভিয়েত পারমাণবিক ব্যবস্থার গভীর সমস্যাগুলোর প্রতিফলন ছিল। ভুল সিদ্ধান্ত, অবহেলা, এবং নিরাপত্তার প্রতি উদাসীনতা মিলে এক ভয়াবহ বিপর্যয় তৈরি করেছিল। আর্থিক হিসেবে সব মিলিয়ে প্রায় ২৩৫ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছিলো এই একটি দূর্ঘটনায়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো এখানকার কৃষিখাত ও প্রিপিয়াত শহরের বাসিন্দারা। আজ, প্রায় ৪০ বছর পরও, চেরনোবিল একটি নিষিদ্ধ এলাকা। এটি 'এক্সক্লুশন জোন' হিসেবে চিহ্নিত, যেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ। প্রিপিয়াত শহর এক ভূতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়েছে। পরিত্যক্ত স্কুল, হাসপাতাল, বাজার, পার্ক, যেখানে একসময় মানুষের হাসি-কান্না প্রতিধ্বনিত হতো, আজ সেখানে শুধু নীরবতা। 
 
বিজ্ঞানীদের মতে চেরোনবিলের পরিবেশ আগের মত মানুষের বসবাস উপযোগী হতে সময় লাগবে প্রায় ২০ হাজার বছর। প্রিপিয়াত শহরে সীমিত পরিসরে মানুষ বসবাস করতে পারবে দুই থেকে আড়াই হাজার বছর পরে৷ তবে অনেক গবেষকরা মনে করছেন প্রকৃতি নিজেই ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠছে তেজস্ক্রিয়তার অভিশাপ। বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর এ অঞ্চলে ফিরে আসাই ইঙ্গিত করছে, প্রকৃতি পুনরুদ্ধার হচ্ছে। তবে এতকিছুর পরেও চেরনোবিল দুর্ঘটনা বিশ্বকে পারমাণবিক নিরাপত্তার গুরুত্ব উপলব্ধি করিয়েছে। এর পর থেকে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর নকশা ও পরিচালনা ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। নতুন কেন্দ্রগুলোতে স্বয়ংক্রিয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা, উন্নত কুলিং সিস্টেম, ও জরুরি শাটডাউন মেকানিজম সংযোজন করা হয়েছে, যেমনটা আমরা দেখতে পাই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে। এ ধরনের দূর্ঘটনা এড়ানোর জন্যই রূপপুরের যাবতীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো হচ্ছে ইউরেনিয়াম লোডের আগেই৷ ব্যায় বেড়ে গেলেও সুরক্ষা ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় এক বিন্দুও ছাড় দেয়া হচ্ছেনা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ