চাঁদপুরের ত্রিমোহনা। যেখানে পদ্মার ঐশ্বর্য, মেঘনার বিশালতা আর ডাকাতিয়ার কোমলতা এসে মিলে গড়ে তোলে এক অভূতপূর্ব জলচ্ছবি। কিন্তু এই দৃশ্যপট অনেক সময়ই হয়ে ওঠে ঘূর্ণিপাকের মৃত্যুক্ষুধা। হাজার মাইল দূরের বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের গল্প অনেকের জানা থাকলেও চাঁদপুরের এই ভয়ংকর ত্রিমোহনার গল্প অনেকেরই রয়ে যায় অজানা। অথচ এই চাঁদপুর ট্রায়াঙ্গেলও সাক্ষী ইতিহাসের অনেক নৌযানের শেষ পরিনতির। যেসব নৌযানের যাত্রীদেরও হদিস মেলেনি কখনোই। কতটা ভয়ানক বাংলাদেশের বারমুডা খ্যাত চাঁদপুর ট্রায়াঙ্গেল?
পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া। তিনটি স্রোতস্বিনী নদী এসে মিলিত হয়েছে চাঁদপুরের ত্রিমোহনায়। স্থানীয়ভাবে এই জায়গাটি কোরাইলার মুখ নামে পরিচিত। সচারাচর এই স্থানটিকে এড়িয়ে চলেন খুব দক্ষ নাবিক এবং জেলেরাও। স্থানীয়দের কাছে মৃত্যুকূপ নামে পরিচিতি পেয়েছে এ জায়গাটি। মূলত তিন নদীর মিলন এবং সরাসরি বঙ্গোপসাগরের সংযোগের ফলে এখানকার স্রোত সম্পর্কে আগাম অনুমান করা সম্ভব হয়না। তিন দিক থেকেই বিপরীতধর্মী স্রোত প্রবাহিত হওয়ায় এখানে সৃষ্টি হয় এক ভয়ানক ঘূর্ণিপাকের। বঙ্গোপসাগরের সংযোগ থাকায় হঠাৎ করেই স্রোতের পরিমান বেড়ে যায় এখানে। আবার তিন দিক থেকে আসা স্রোত বিপুল পরিমান পলি বহন করে সৃষ্টি করে ডুবো চরের। অনেক সময় নৌচালকদের পূর্ব অভিজ্ঞতা বা নেভিগেশন দক্ষতাও এই অনিশ্চয়তা সামলাতে ব্যর্থ হয়। ফলে প্রতি বছরই বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে নৌ-দূর্ঘটনা বেড়ে যায়।
ছোট ছোট নৌকা থেকে বিশালাকৃতির জাহাজ, কোনো কিছুই রেহাই পায়না এই ঘূর্ণিপাক থেকে। অসাবধানতাবসত কোনো নৌযান এর কাছাকাছি চলে এলে হঠাৎই ঘূর্ণয়মান স্রোতের টানে নিচের দিকে নেমে যেতে থাকে। আর এই তীব্র স্রোতের সামনে এক কথায় অকার্যকর হয়ে যায় শক্তিশালী সব ইঞ্জিনও। যার ফলে সেসব নৌযানের শেষ গন্তব্য হয়ে যায় নদীর অতল গহ্বরে। আর নদী উত্তাল থাকায় উদ্ধারকর্মীরাও হয়ে পড়েন অসহায়। এখানে জাহাজ উলটে যাওয়ার ঘটনাও মোটেই বিরল নয়। সরকারি হিসাবমতে গত তিন দশকে এ অঞ্চলে নৌ দূর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা দুই হাজারেরও বেশি। এর মাঝে ২০০৩ সালে এমভি নাসরিন নামের একটি লঞ্চডুবিতে ১১০ জন নিহত এবং ২০০ জনের বেশি নিখোঁজ হওয়ার খবর পাওয়া যায়। তবে লঞ্চটির উদ্ধারকাজ কখনোই সম্ভব হয়নি। এছাড়া এমভি রাজহংস, এমভি সালাহউদ্দিন-২, এমভি মহারাজসহ ছোট বড় অসংখ্য নৌযানের দূর্ঘটনার ইতিহাস রয়েছে এ অঞ্চলে। যার বেশিরভাগেরই শেষ পরিনতি এমভি নাসরিনের মতই। সাম্প্রতিক সময়েও ঘটে চলছে দূর্ঘটনা। তবে আধুনিক নেভিগেশন এবং দক্ষ চালকদের সমণ্বয়ে এখন বেশিরভাগ নৌযানকেই ঘূর্ণিপাকের এই এলাকাকে এড়িয়ে যেতে দেখা যায়।
প্রকৃতির নিজ হাতে তৈরি এক ভয়ংকর সুন্দর জায়গা চাঁদপুরের ত্রিমোহণা। তীব্র স্রোত এবং উত্তাল নদী মনের খোরাক যোগায় এডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষের৷ তবে এই অঞ্চলে হারিয়ে যাওয়া প্রতিটি প্রাণই অমূল্য। কোনো দূর্ঘটনার খবর পেলে সাথে সাথে উদ্ধার অভিযান শুরু হয়। কিন্তু প্রাকৃতিক উদ্দামতা অনেক সময় মানুষের থেকে কেড়ে নেয় আপনজনের মৃতদেহটিকেও। মৃত্যুক্ষুধায় বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলকেও হার মানায় বাংলাদেশের চাঁদপুর ট্রায়াঙ্গেল।
0 মন্তব্যসমূহ