ডঃ গৌতম সরকার
পরেরদিন জলখাবার খেয়ে ম্যানেজার সাহেবের ব্যবস্থা করে দেওয়া একটা অটোয় চেপে রওয়ানা দিলাম পরেশনাথ রেলস্টেশনের উদ্দ্যেশে। পথ খুব বেশি ছিলনা, বাদামী পাহাড়ের মধ্য দিয়ে কালো পিচের সর্পিল পথ, গাছপালার স্বল্পতা এখান থেকেই শুরু হয়ে গেছে। তখন তো এখনকার মত স্মার্টফোন আবিষ্কার হয়নি, তাই রুক্ষ প্রকৃতি ক্ষণে ক্ষণে আমাদের অভিভূত করলেও অটো থামিয়ে ছবি তোলার ইচ্ছে দমন করতে হল। তখন কোডাক ক্যামেরা আর ফিল্মের খুব বাজার ছিল। প্রথমদিকে কুড়ি শটের রিল এবং পরবর্তীতে বত্রিশ শটের রিল পাওয়া যেত, এরকম একটা কি দুটো রিলের মধ্যে গোটা ভ্রমন পাঁচালির চিত্ররূপ দিতে হত। তাই আদেখলের মতো যাই দেখলাম তার সামনেই পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে ছবি তোলার যুগ সেটা ছিলনা৷ স্টেশনটি একদম পরেশনাথ পাহাড়ের কোলে অবস্থিত। পৌঁছে অটো ছেড়ে গুটি গুটি টিকিট কাউন্টারের দিকে হাঁটা দিলাম। সঙ্গে লাগেজ বলতে দুজনের কাঁধে দুটো ব্যাগ, আমার অন্য কাঁধে আরেকটা কাপড়ের ব্যাগ, যেখানে ক্যামেরা, জলের বোতল, টুকটাক খাবার আছে।
আগেই বলেছি, যে জায়গায় যাচ্ছি সেই জায়গাগুলির ভৌগোলিক অবস্থান সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান খুব সীমিত ছিল। আর এখনকার মত হুট বলতেই গুগলবাবার শরণ নেওয়া যেতনা। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল, নেতারহাট। কিন্তু তার আগে হাজারীবাগ হয়ে রাঁচি পৌঁছতে হবে। তাই সবটাই লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে করতে হবে। টিকিট কাউন্টারে গিয়ে আগে ফেয়ার চার্টে চোখ বোলাই। এটা তখন আমাদের প্রাথমিক কাজ ছিল, কারণ টিউশন আর দিদির কাছ থেকে কয়েকটা টাকা নিয়ে দুজনে বেরিয়ে পড়েছি, প্রতিটি পাইপয়সা হিসেব কষে খরচ না করলে বেড়ানোর মাঝপথ থেকেই ফিরে যেতে হবে। ফেয়ার চার্টে চোখে পড়লো, হাজারীবাগ রোড স্টেশনের ভাড়া মাত্র পাঁচ টাকা। মনটা আনন্দে নেচে উঠলো, হাজারীবাগ রোড স্টেশন থেকে হাজারীবাগ নিশ্চয়ই কাছেপিঠেই হইবে; আর যে জায়গা পৌঁছানোর ভাড়া মাত্র পাঁচ টাকা সেটার দূরত্বও আহামরি কিছু হবেনা। আনন্দ করতে করতে দুটো টিকিট কেটে নিয়ে প্ল্যাটফর্মে এসে গাড়ির অপেক্ষা করতে লাগলাম। কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করারও দরকার মনে করলামনা। মনে হল, ‘মার দিয়া কেল্লা’। হাজারীবাগ পৌঁছেই রাঁচি চলে যাবো, ওখান থেকে একটা বাস ধরে নেতারহাট। সবকিছু ঠিকঠাক চললে বিকেল বিকেল নেতারহাট পৌঁছে যাব। দুই কিশোরের চোখে তখন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব গুহর নেতারহাট স্বপ্নকাজল ছুঁইয়ে দিয়েছে। উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ ধরে, কখনো বা উপত্যকার বুকে দুটি দামাল ছেলে, খোলা গলায় 'সেগুনমঞ্জরী থেকে বৃষ্টি ঝরে' আবৃত্তি করে গাছে গাছে পলাশ ফোটাচ্ছে, হালকা হাওয়ায় শিমুল তুলো ভাসিয়ে দিচ্ছে ঝিলের দিকে, মহুয়ার নেশায় পাশ দিয়ে চলে যাওয়া সাঁওতালি রমনীদের চোখ প্রেমমদির করে তুলেছে।
আধঘন্টায় হাজারীবাগ রোড স্টেশন এসে গেল, স্টেশনের বাইরেটা বেশ জমজমাট। বেরিয়ে এসে হাজারীবাগ শহর যাওয়ার হালহকিকত জিজ্ঞাসা করতে পুরো বুরবাক হয়ে গেলাম। শুনলাম, এখান থেকে হাজারীবাগ শহর বহু বহু কিলোমিটার দূর। ওদের মুখের হাসি দেখে বুঝতে পারলাম এই হাজারীবাগ রোড আর আসল হাজারীবাগের গোলকধাঁধার চক্করে পড়া আমাদের মতো বুরবাকদের সাথে মাঝেমাঝেই ওনাদের মোলাকাত হয়। কিভাবে যাওয়া যায় জিজ্ঞাসা করাতে অবশ্য সিরিয়াস হয়েই বললেন, “কাল এখানকার হোলি, মানুষ আজ থেকেই মেতে উঠেছে। বেলা বারোটার পর আর কোনো যানবাহন পাবেননা। আর গোটা বিহারেই এই অবস্থা হবে। আপনারা আজ কিভাবে হাজারীবাগ পৌঁছবেন ?”
শুনে তো আমাদের আক্কেল গুড়ুম, জানি আজ বাংলায় আর কাল বিহারে (তখন ঝাড়খন্ড ভাগ হয়নি) হোলি, ওই কারণেই আজকের মধ্যেই নেতারহাট পৌঁছে নিশ্চিন্তে বসতে চাইছিলাম, কিন্তু আজ থেকেই সেই হোলির প্রস্তুতিতে এখানকা জনজীবন স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার যোগাড় হবে কে জানতো ! তড়িঘড়ি ছুটলাম বাসস্ট্যান্ডের দিকে। স্টেশনের বাইরে বাসস্ট্যান্ডে বেশ কয়েকটি বাস দাঁড়িয়ে, তবে সবকটিরই দরজা বন্ধ, অর্থাৎ ব্যবসা বন্ধ। আশপাশে দোকানপাট খোলা, লোকজন বেশ উৎসবের মেজাজে চা খাচ্ছে, বিড়ি ফুঁকছে, আমাদের দিকে চোখ তুলে তাকানোর অবকাশ কারোর নেই। তবু দায় যেহেতু আমাদের তাই গরজটা আমাদেরই দেখাতে হবে। জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, এই বাস ডিপো থেকে আজ আর কাল কোনো বাস ছাড়বেনা। ডিপোর স্টার্টার অফিস বন্ধ করে কর্মীরা বাড়ি চলে গেছে। আর এখানে এই একটাই বাস ডিপো, অন্য কোনো জায়গা থেকে কোনো বাস ছাড়ার আশা নেই। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম, এককাপ চা খাবো সে ইচ্ছাও চলে গেছে। সূর্য আস্তে আস্তে মাথার ওপর চড়ছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে উত্তাপ। একটু সরে গিয়ে একটা শেডের নিচে দাঁড়ালাম। মুখে কিছু না বললেও দুজনের মাথায় একই চিন্তা- রেস্ত তো ফিক্সড, এখন এভাবে রাস্তায় দুদিন আটকে গেলে নেতারহাট নয়, পরশুদিন এখান থেকে কলকাতাগামী ট্রেনের সন্ধান করতে হবে। ইতিমধ্যে আমাদের মত বেশ কিছু আটকে পড়া মানুষজন বাসস্ট্যান্ডে ঘুরপাক খাচ্ছে। তবে তাঁরা কেউ ট্যুরিস্ট নন, স্হানীয় লোক সবাই হোলিতে বাড়ি ফিরছে। কিছুক্ষণ পর সেরকমই একজন এসে খবর দিলেন তারা কয়েকজন মিলে একটা ট্রেকারকে রাজি করিয়েছে, তবে সেটা হাজারীবাগ যাবেনা, অনেক কষ্টে কিছুটা এগিয়ে দিতে রাজি হয়েছে। আমরা তখন বাছাবাছির মত অবস্থায় নেই, যতটা এগিয়ে যেতে পারি ততই মঙ্গল। আর কিন্তু চিন্তাভাবনা না করে গাড়িতে চেপে বসলাম।
গাড়ি চলতে শুরু করলো ছোট, বড় জনপদের মধ্য দিয়ে। কোথায় যাচ্ছি, কতদূর যাচ্ছি কিছুই বুঝছিনা। গাড়ির পিছনে অন্যান্য যাত্রীদের সাথে বোকা বোকা মুখে বসে রইলাম। বেশ কয়েক ঘন্টা যাবার পর একজায়গায় এসে সবাইকে নামিয়ে দিল। ভাড়া নিল মাথাপিছু ছয় টাকা। দিতে বেশ কষ্ট হলো, কারণ এগুলো হিসেব বহির্ভুত খরচ হচ্ছে, গন্তব্য পৌঁছতে এরকম আর কত খরচ হবে বুঝতে পারছিনা। গাড়িটা আমাদের যেখানে নামালো সেই জায়গাটির নাম এখন ভুলে গেছি তবে জায়গাটা ছিল একটা হাইওয়ের ওপর। রাস্তা দিয়ে মুহুর্মুহু বড় বড় ট্রাক যাচ্ছিল মনে আছে, যাত্রীবাহী বাস তখন বন্ধ হয়ে গেছে। রাস্তার পাশে আশায় আশায় বসে আছি যদি হাজারীবাগ যাওয়ার কোনো গাড়ির ব্যবস্থা হয়। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করেও হতাশ হতে হল। ইতিমধ্যে বিহার তার রূপ বদলাতে শুরু করেছে। আশপাশের পরিবেশ-প্রকৃতি এবং লোকজনের হাবভাব খুব দ্রুত বদলাতে শুরু করলো। ইতিমধ্যেই পরের দিনের হোলির উদযাপনে কিছু মানুষের পা টলমল করতে শুরু করেছে, আর অল্পবয়সী কিছু ছেলের চালচলন, দৃষ্টি মোটেই সুবিধের মনে হচ্ছেনা। আমরা যারা গাড়িতে একসাথে এসেছি তাদের অনেকেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। কয়েকজন হাজারীবাগগামী যাত্রী একসাথে কিছু একটা ব্যবস্থার চেষ্টা করছিলেন, সেটা না হওয়াতে তারাও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আমি গতিক সুবিধের না দেখে পবিত্রকে কাছাকাছি হোটেলের সন্ধানে পাঠিয়েছি। সঙ্গে আমাদের সঙ্গে আসা এক ভদ্রলোকও গেছেন। কারণ কোনো ব্যবস্থা না করতে পারলে এই পরিবেশে তো রাস্তায় রাত কাটানো যাবেনা। ইতিমধ্যে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, অল্পবয়সী সেই ছেলের দল রাস্তার মাঝখানে গিয়ে হাত দেখিয়ে বড় বড় ট্রাকগুলোকে থামাচ্ছে, তারপর দু-তিনজন পা-দানিতে উঠে ড্রাইভারের কাছ থেকে টাকা চাইছে। না দিলে জোর করে দরজা খুলে ড্রাইভারকে রাস্তায় নামিয়ে ধমকাচ্ছে, চমকাচ্ছে। একজনকে দেখলাম, রাস্তায় ফেলে কোমরের গেঁজেয় রাখা টাকার বটুয়া কেড়ে নিয়ে ধাক্কা মেরে গাড়িতে তুলে দিল। এই পর্ব চোখের সামনে চলতে থাকায় ভয় পেয়ে গেলাম। পবিত্ররা ফিরতে দেরি করছে, আমি বড় রাস্তা ছেড়ে একটু ভিতরের দিকে ঢুকে এলাম। যদিও আমার কাছ থেকে নেওয়ার মতো যথেষ্ট টাকাপয়সা নেই, তবুও যেটুকু আছে সেটা নিয়ে নিলে এই বিদেশ বিভুঁইয়ে সত্যি করে পথে বসতে হবে।
পবিত্র ফিরে এসে জানালো- হোটেল আছে। ভাড়ার কথাও জানালো। মন বলছে কিছু একটা ব্যবস্থা হোক, অন্ততঃ হাজারীবাগ পর্যন্ত যেন চলে যেতে পারি। নেতারহাট পৌঁছনোর আশা আগেই ছেড়ে দিয়েছিলাম, এখন রাঁচির আশাও ছাড়লাম। এখনও আশা কাল ভোর ভোর হাজারীবাগ থেকে বেরিয়ে রাঁচি পৌছিয়ে যদি কোনোমতে নেতারহাটের বাসে উঠে পড়তে পারি। কিন্তু এই মুহূর্তে একটা ফালতু জায়গায় ফেঁসে আছি যে এখানে থাকলে আগামী দুদিন এখানেই পড়ে থাকতে হবে, উদ্ধারের কোনো আশা নেই।
সন্ধ্যে গড়িয়ে গেছে, গাড়ি থামিয়ে লুটতরাজ আরও খুল্লামখুল্লা চলছে, তবে আমাদের এখনও কেউ ডিস্টার্ব করেনি। আমরাও অন্ধকারে রাস্তার পাশেই ইতস্ততঃ ঘুরে বেড়াচ্ছি, এখনও আশা যদি কোনো গাড়ীর ব্যবস্থা হয়। আটটা নাগাদ সমবেত চেষ্টায় একটা গাড়ির ব্যবস্থা হল। আমাদের সঙ্গে যারা হাজারীবাগ রোড থেকে এসেছেন, তাঁরা অনেক দূর থেকে পরিবারের সাথে হোলি কাটানোর জন্য আসছেন, আজ বাড়ি পৌঁছতে না পারলে এই কষ্টটা বৃথা যাবে, তাই তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ছিলই। তাঁরা সবাই হাজারীবাগের আশপাশে যাবেন। আমাদেরও তাঁরা সহযাত্রী করে নিলেন। গাড়ি নটা নাগাদ ছাড়ল। গাড়ি ছাড়তেই আমি আর পবিত্র পুরোনো ফর্মে গেলাম। আবার প্ল্যান শুরু হয়ে গেল। পৌঁছেই একটা হোটেলে ঢুকে পড়তে হবে, কাল ভোরের প্রথম বাসে করে রাঁচি পৌঁছতে হবে। তারপর ওখানে গিয়ে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। গাড়ির অন্যান্য যাত্রীরা হিন্দিভাষী, নিজেদের মধ্যে কথাবার্তায় ব্যস্ত। আমরা পিছনে বসে বাংলায় কথা বলছি, আমাদের কথা কেউ বুঝছে বা কানে নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছেনা। ওনাদের কথা থেকে জানলাম আমাদের হাজারীবাগ পৌঁছতে আড়াই-তিনঘন্টা লাগবে। গাড়িতে ওঠার আগে দোকানে এককাপ করে চায়ের সাথে একটা করা পাউরুটি খেয়ে নিয়েছি। আপাতত মনে হচ্ছে রাতে কিছু না খেলেও চলবে। আর বারোটার পর হোটেলে ঢুকে কেউ গরম গরম খাবার নিয়ে দরজার কড়া নাড়বে, এটা আশা করা ধৃষ্টতা হয়ে যাবে। আর কয়েকঘন্টার তো রাত্রিবাস, তারপর ভোরবেলায় বেরিয়ে পড়তে হবে। খাওয়া-দাওয়ার চিন্তা কাল করলেই চলবে। কিন্তু আমাদের চাপ হয়ে যাচ্ছে এই এক্সট্রা খরচগুলো। কিন্তু কি আর করা! এই পরিস্থিতিতে পড়তে হবে সেটা তো বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় ভাবিনি। গাড়ি চলতে থাকলো, বাইরে ভরা পূর্ণিমার রাত, এখন আমরা ধু ধু মাঠের ওপর দিয়ে যাচ্ছি। বিহারের এই রুক্ষ সৌন্দর্য একটু অন্য ধরনের, মন খারাপ করিয়ে দেয়। ট্রেনে করে যেতে যেতে বহুবার বিহার, উত্তরপ্রদেশের ধূসর, রুক্ষ, বন্ধ্যা প্রকৃতিকে দেখেছি৷ মনে হয়েছে, প্রাকৃতিক সম্পদের এ কি অপব্যয় ! এই সমস্ত মাঠে যদি ফসল ফলানো যেত তাহলে হয়তো ভারতবর্ষের কোনো মানুষকে খিদেয় কষ্ট পেয়ে দিন কাটাতে হতোনা। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর সামনের সিট থেকে এক ভদ্রলোক মুখ ঘুরিয়ে পরিষ্কার বাংলায় জিজ্ঞাসা করলেন, "আপনারা বাঙালী?" আমরা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাম। একটু অবাক হয়ে গেছি, দলে যে আরেকজন বাঙালি আছে খেয়াল করিনি। ভদ্রলোককে ভালোভাবে লক্ষ্য করতে চিনতে পারলাম, ইনিও আমাদের সাথে হাজারীবাগ রোড থেকে এসেছেন। এই দীর্ঘ যাত্রাপথে নিশ্চয়ই কথাও বলেছেন, কিন্তু বাংলা বলতে শুনিনি। কিছুক্ষণ পর বুঝলাম উনি প্রবাসী বাঙালি। টাটায় নিজের পরিবার নিয়ে থাকেন, হোলিতে মা, ভাই- বোনেদের সাথে কাটানোর জন্যে হাজারীবাগে আসছেন। এতক্ষন সামনে বসে আমাদের বকবকানি শুনে আমাদের আগামী প্ল্যানের ব্যাপারে জেনে গেছেন। তিনি জানালেন- হাজারীবাগে হোটেল হয়তো পাবেন, কিন্তু খাবার পাবেননা। কারণ হোলিতে হোটেলের সমস্ত স্টাফ ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যায়, আর কাল সকালে হাজারীবাগ বাস ডিপো থেকে কোনো বাস ছাড়ার সম্ভাবনা নেই। আমরা আর কি বলবো, চুপ করে বসে থাকি। কিন্তু মনে মনে আশা ছাড়িনা, একটা মরিয়া চেষ্টা করতে হবে। বাস, ট্রাক, টেম্পো যা পাই কোনোরকমে রাঁচি কাল পৌঁছতেই হবে। বুঝতে পারছি পবিত্রর মনও তাই বলছে। বেড়াতে এসে দু দুটো দিন এভাবে ফালতু কেটে যাবে ভাবতেও পারছিনা। ইতিমধ্যে আমরা হাজারীবাগের শহরতলিতে এসে পৌঁছেছি। এক এক করে যাত্রী নেমে যাচ্ছে। শহরে ঢোকার পর ওই বাঙালি ভদ্রলোকের গন্তব্য এসে গেল, উনি ড্রাইভারের পাশে বসেছিলেন। গাড়ি থেকে নেমে উনি ড্রাইভারকে তিন আষ্টে চব্বিশ টাকা ভাড়া দিলেন। আমরা একটু অবাক হলাম। গাড়িতে ওঠার সময় জেনেছিলাম মাথাপিছু আট টাকা করে ভাড়া। এবার উনি বাইরে থেকে আমাদের দিকের দরজা খুলে বললেন, “নেমে আসুন”। আমরা তো কিছু বুঝে উঠতে পারলামনা, দুজনে দুজনের মুখের দিকে তাকাচ্ছি। পবিত্রও হতভম্ব হয়ে গেছে। ভদ্রলোক এবার জোরের সঙ্গে বললেন, “আরে ভদ্রলোকের ছেলে, আবার বাঙালি। এই রাত্রে বিদেশ বিভূঁইয়ে এসে বিপদে পড়বেন সেটা কি ভালো দেখায়”৷ আমরা কিংকর্তব্যবিমুড়! উনি বললেন, “আর এত রাতে হোটেলও পাবেন কিনা সন্দেহ আছে”৷ আমি বললাম, চিন্তা করবেননা, আমরা বাসস্ট্যান্ডে কোনরকমে রাতটা কাটিয়ে কাল সকালে একটা কিছু ধরে নেব। উনি বললেন, “কাল কিছু পাবেননা, আর ওই বাস স্ট্যান্ডে এই রাতে কি চলে আপনাদের ধারণা নেই। ওখানে গেলে বিপদে পড়বেন। চলে আসুন, আজ রাতটা আমাদের বাড়িতে থাকুন, কাল যা হয় দেখা যাবে”। এদিকে ড্রাইভার সাহেবও ঘন ঘন হর্ন দিচ্ছে, অন্যান্য যাত্রীরাও আমাদের এই প্রলম্বিত নাটকে অধৈর্য হয়ে পড়ছে বুঝতে পারছি। তাই ইতস্ততঃ করে নেমে পড়লাম।
(ক্রমশঃ………)
0 মন্তব্যসমূহ