লেখা-পার্থসারথি
এই মাসটা ব্যস্ততার মাঝে ভালো কেটেছে রুচিরার। সৈকত, পারমিতা, চাকরি আর জীবনের প্রাসঙ্গিক টুকিটাকিতে ডুবে থেকে থেকে একঘেমেয়ি থেকে কিছুটা হলেও দূরে থাকতে পেরেছে। হঠাৎ করে রুচিরা নিজেকে সুখী ভাবতে চেষ্টা করছে।
চাকুরি করে, লেখাপড়ার তেমন কোন অসুবিধা হচ্ছে না। বরং জীবনে অন্যরকম একটা ছন্দময়তা জড়িয়ে থাকে। যা রুচিরাকে সর্বক্ষণ নতুন করে বাঁচতে তাগিদ দিচ্ছে।
অনেকেই রুচিরার রূপের কথা বলাবলি করে বলে যে, মেয়েটা খুবই দেমাগি।
এ'কথাটা রুচিরার কানেও এসে পৌঁছে গেছে। একমাত্র রুচিরাই জানে, সে কেন সর্বক্ষণ এত চুপচাপ থাকে। প্রত্যেকের জীবনে এমন কিছু ঘটনা থাকে যা জীবনের কোন না কোন সময়ে ভাবিয়ে তোলে। আবার এমন কিছু ঘটনা থাকে যার বেড়াজাল থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখা খুবই কঠিন ব্যাপার। রুচিরা নিজের কষ্টটাকে এক মুহূর্তের জন্যেও আড়াল করতে পারে না। ছায়া হয়ে মনের আঙিনায় র্সবক্ষণ বিচরণ করে। কষ্টের মাঝেই বর্তমানে রুচিরার বসবাস। তাই চুপচাপ থাকতেই বেশি পছন্দ করে। সৈকতের সাথে ইদানিং সম্পর্কটা একটু ঘনিষ্ঠ হয়েছে।
পারমিতার সাথে পরিচয় পর্বটা একটু ভিন্ন আঙিকের। পারমিতা পাশের বিল্ডিংয়ে থাকে। একদিন বিকেলে রুচিরা সবুজ ঘাসের বুকে নিজের মনকে বিছিয়ে চুপচাপ বসে আছে। পারমিতা অনেকের কাছে রুচিরা সম্পর্কে শুনেছে। কিন্তু ওই মুর্হূতে পারমিতার কেনো যেনো মনে হলো, মেয়েটা খুবই অসুখী। পারমিতা ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে যায়। কাছাকাছি হয়ে অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে থাকে। রুচিরার চিন্তা জগতে কোন রকম ভাবান্তর হয় না।
অনেকক্ষণ পর পারমিতা বলে- আপা একটু বসতে পারি কি?
রুচিরা ফিরে তাকায় । কিছুটা আশ্চর্য হয়। কারণ মেয়েটা অপরিচিত। কোন চেনা মেয়েও সাধারণত যেচে এসে রুচিরার সঙ্গে কথা বলে না। রুচিরা স্মরণ করার চেষ্টা করল, পূর্বে কখনও পরিচয় হয়েছিল কিনা। কোনভাবেই পরিচিত সীমানায় আনতে পারছে না।
আপা বসতে পারি?- পারমিতা আবারও বলে।
রুচিরা এবার স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে, বলে অবশ্যই, অবশ্যই।- এই বলে পাশের জায়গাটুকু ইশারায় দেখিয়ে দেয় রুচিরা পারমিতা ঘাসের ওপর চেপে বসে। পারমিতার হাতে কোন কাজ নেই। ইচ্ছে ছিল বান্ধবীকে নিয়ে একটু বৈকালিক হাঁটাহাঁটি করবে। বান্ধবীটি রুমে ফিড়েও নি। তাই হলের ভেতরই পারমিতা হাঁটাহাটি করছিল। এই সময় অনেকে বন্ধুদের নিয়ে বাইরে আড্ডা দেয়। তবে বেশি সংখ্যক মেয়েরা হলের ভেতরই সময় কাটায়। কেউ হয়তো পেপার রুমে, কেউবা লাইব্রেরিতে আবার গেমস রুমেও অনেকে সময় কাটায়। রুমের ভেতর আড্ডাও বেশ জমে। অনেকে এটা-সেটা কেনার জন্য নিউ মার্কেট অথবা গাউছিয়া মার্কেটে যায়।
রুচিরা যেখানটায় বসে আছ , এখানে সচরাচর কেউ বসতে আসে না। পারমিতা ইচ্ছে করেই এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করছিল। হঠাৎ চোখ পড়ে, একটা মেয়ে নির্জন জায়গায় চুপচাপ একাকী বসে আছে।
নীরবতা ভেঙে রুচিরা বলে, কিছু বলবেন কি?
নিদিষ্ট কিছু বলব বলে আসিনি। আপনাকে দেখে কাছে বসতে ইচ্ছে জাগলো তাই আসা।- পারমিতা আন্তরিকতার সহিত কথাগুলো বলল।
রুচিরা সত্যিই অবাক হল। হল জীবনের এই আড়াইটা বছরে এমন ঘটনা ঘটে নি। যাদের সাথে হালকা পরিচয় ছিল তারাও অনেক দূরত্ব বজায় রেখে চলে। অবশ্য এর মূল কারণ রুচিরা নিজে। রুচিরা ইচ্ছে করেও জীবনের প্রাণ-চঞ্চল্যময় মুহূর্তগুলো ফিরিয়ে আনতে পারে না। ফলে বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যা বাড়ে নি। অথচ এই অপরিচিত মেয়েটা যেচে এসে পাশে বসল। রুচিরা পারমিতার চোখের কাছাকাছি চোখ রেখে বলল আপনি আমার সম্পর্কে কোন কিছুই শোনেন নি?
শোনেছি।
তবে?
কান কথায় আমি কখনও বিশ্বাস করি না।
হতেও তো পারে।
আমার মনে হয় এ পরিস্থিতির জন্য আপনি নিজে দায়ী। পারমিতা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বলে।
রুচিরা অবাক দৃষ্টিতে তাকায়। পারমিতা চোখ ফেরায় না। রুচিরা স্বাভাবিক কণ্ঠেই আবার বলে আপনি আমাকে কতটুকু জানেন?
আপনার সাথে আজই প্রথম কথা বলছি। জানব কোথা থেকে? যতটুকু জেনেছি অন্যদের কাছ থেকে শোনে শোনে।
যা জেনেছেন তা সত্যিও তো হতে পারে নাকি?
ধরে নিলাম সত্যি । কিন্তুু আপনি আমার কথা এড়িয়ে যাচ্ছেন। রুচিরা চুপচাপ বসে থাকে। ঘাসের বুকে আপন মনে চিমটি কাটে। আর ভাবে- এই মেয়েটা সত্যিই কত আপন হয়ে কথা বলছে। কথার মধ্যে শাসন জড়িয়ে আছে অথচ কত বিনম্র উচ্চারণ।
মানুষ ভুল করে। সেটা আবার নিজেকেই শোধরাতে হয়।- পারমিতা রুচিরার অবনত মুখমন্ডলে তাকিয়ে বলে।
মানুষ তার পরিবেশ নিয়েই বলে। মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব-সবার সাথেই জীবনের কোন না কোন অংশ জড়িয়ে আছে। তারপরও সবার একটা ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধ জীবন থাকে।– কথাগুলো বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে এক নিঃশ্বাসে বলে রুচিরা পারমিতার দিকে তাকায়।
রুচিরার চোখ জোড়া অশ্রুতে টলমল করছে। পলকহীন দৃষ্টি। এক পলক জড়িয়ে এলেই যেন চোখের জল টপটপ করে গড়িয়ে পড়বে। পারমিতার মনটা অসম্ভব রকমের খারাপ হয়ে গেল। মুহূর্তের নিঃশ্বাসে কণ্ঠস্বর বাষ্পরুদ্ধ হয়ে গেল। রুচিরার হাত দুটো টেনে চেপে ধরে কোন মতে উচ্চারণ করল- আপনাকে কষ্ট দিয়ে থাকলে ক্ষমা চাচ্ছি। আসলে আমি আপনাকে কষ্ট দেয়ার জন্য কথাগুলো বলি নি।
রুচিরার উচ্চারণ আমি কষ্ট পাইনি। একটুও না। আপনি আমাকে বুঝতে পেরেছেন তাই খুশিতে কান্না আসছে। এই প্রথম কেউ আমাকে বুঝতে চেষ্টা করছে। -বলে রুচিরা ডুকরে কেঁদে উঠল। পারমিতা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। আরও কাছাকাছি হয়ে পারমিতা রুচিরাকে হালকাভাবে জড়িয়ে ধরল।
অনেকক্ষন নীরবতা। হালকা বাতাসে শেষ বিকেলের আমেজ ছড়িয়ে পড়ছে। প্রশান্ত বাতাসের স্পর্শে রুচিরার মনের রঙ একটু একটু করে পাল্টে যেতে লাগল। রুচিরা এই পরিবর্তনের পালাবদল একটুও টের পায় নি। প্রত্যেকের জীবনে ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধ আঙিনা থাকে ঠিকই কিন্তু এই সীমাবদ্ধ আঙিনায় অন্তত একজনকে বিচরণ করতে দিতে হয়। আর নয়তো বুকের ভেতর একটা অস্বস্তি কুটকুট করে যন্ত্রণায় দগ্ধ করে চলে। এই বিষাদময় মুহূর্তটুকু যেন কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্যরূপ ধারণ করল। নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে রুচিরার মনের সবুজভূমি আকুল হয়ে ওঠল। অসহায় দৃষ্টিতে রুচিরা পারমিতার চোখে চোখ রাখে।
পারমিতা ভরসা দেবার ভঙ্গীতে বলে- যদি মনে কিছু না করেন, অবশ্য এই অল্প সময়ে এত কাছাকাছি হওয়াটা ঠিক।- পারমিতা আমতা আমতা করছিল।
রুচিরা আগ্রহভরা কণ্ঠে বলে কোন সংকোচ রাখবেন না। যা ইচ্ছে হয় খুলে বলুন। আমি সব শুনব। শোনেন, কিছু মানুষ আছে যাদের চিনতে দেরি হয় না। এই যে আপনি, পরিচয় মাত্র কয়েক মিনিট হল। অথচ মনে হচ্ছে কয়েক যুগ ধরে আপনি আমার পরিচিত।
আপনি আপনার কষ্টের সাথে অন্য কাউকে জড়ান, দেখবেন কষ্টটা অনেক হালকা হয়ে গেছে।
রুচিরা আবার চুপ মেরে যায়। গভীর হয়ে কী যেন ভাবে। তারপর পারমিতার দিকে ফ্যাল-ফ্যাল চোখে তাকায়। রুচিরা হঠাৎ একটু উত্তেজিত হয়ে বলে আমি আমার জীবনটা একা একা উপভোগ করতে চাই। কোন পুরুষকেই আমি আর বিশ্বাস করতে পারছি না।
পারমিতা বুঝতে পারে যে, ওর কথার মানেটা অন্যরকমভাবে নিয়েছে, - পারমিতা আবার বলে আমি কথাটা সে অর্থে বলি নি। আমি বলতে চাচ্ছিলাম যে, আপনার বুকের ভেতর যে কষ্টটা, সেটি অন্য কারও কাছে বলে একটু হালকা হোন। যেমন আপনার মা-বাবা অথবা কোন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছে সেটা বলতে পারেন। দেখবেন নিজের ভেতরটা বেশ হালকা হয়ে গেছে।
কথাগুলো শোনার পরপরই রুচিবার দৃষ্টি অন্য রকম হয়ে গেল। যেন ভরসা খুঁজে পেয়েছে- এমন ভাব। রুচিরা অনেকদিনই এমনটা ভেবেছে কিন্তু বলার মতো তেমন কোন কাছের জন পায় নি। পারমিতার চোখে-মুখে সুখের বর্ণচ্ছটা খেলে যাচ্ছে। রুচিরার ভাবনার জগতে পারমিতা। রুচিরা ভাবে, এ মেয়েটাই সত্যিকার অর্থে বন্ধু হবে। কারণ, সে মানুষকে বুঝতে পারে। যদিও কিছুক্ষণ আগে পরিচয় হয়েছে, তাতে কোনরকম অসুবিধা নেই। ওকেই সব বলতে হবে।
বলতেই হবে তেমন কোন কথা নয়। আমার মনে হল তাই বললাম। পারমিতা স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে।
তারপর হঠাৎ করেই রুচিরা বলে, ফেলে আমি আপনাকেই আমার কষ্টের সীমানায় টানতেই চাই।
পারমিতা অবাক হয়। কিছুক্ষন হল পরিচয় হয়েছে। জানা-শোনা নেই, একজনের কাছে কি এত সহজেই সবকিছু বলতে পারে! হয়তোবা হতেও পারে।
রুচিরাকে প্রশ্ন করে, বলে আচ্ছা আপনি আমাকে তো একদমই জানেন না, চিনলেন এই একটু আগে। তাহলে আমার কাছে বলতে চাচ্ছেন কেন?
সবসময় সব কথার ব্যাখ্যা করে বলা কঠিন। তবে আমি এটুকু বুঝতে পারছি, আপনি এই অল্প সময়েই খুব কাছের হয়ে গেছেন। পারমিতা জবাবে আর অন্য কিছু বলেনি। রুচিরা নিজের ভেতর জগতের পুরো আঙিনাকে ওলট-পালট করে সুস্থির করে নেয়। স্বৃতির অধ্যায়ে লেপটে থাকা কষ্টগুলোকে নাড়া দেয়। ভীষণ রকমের কষ্ট রুচিরা চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ বসে থাকে। পাশাপাশি পারমিতা চুপচাপ রুচিরার দিকে তাকিয়ে আছে। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে রুচিরা চোখ মেলে তাকায়; সরাসরি পারমিতার চোখে চোখ । তারপর পারমিতাকে বলে ‘আপনি আবার কিছু মনে করবেন না। আপনাকে আমার খুব ভালো লেগেছে, তাই বলতে যাচ্ছি। তাছাড়া একজনকে না হয় একজনকে তো বলতেই হবে।
না, না কী যে বলেন। অবশ্যই বলতে পারেন। তবে এর আগে আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন, কারণ আমি ফার্স্ট ইয়ারে আর আপনার ব্যাপারে জানি।- এই বলে পরিবেশটা একটু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে পারমিতা। পারমিতার কথার পিঠে কথা না বলে রুচিরা চোখজোড়া নীল আকাশের বুকে মেলে দিল। তারপর স্মৃতির পাতায় টেনে নিয়ে গেল পারমিতাকে - আমি তখন ইউনিভার্সিটিতে মাত্র ভর্তি হয়েছি। সম্ভবত মাস তিনেক ক্লাস হয়েছে। বাড়ি থেকে চিঠি এলো, বাবা লিখেছেন চিঠি পাওয়া মাত্রই যেন বাড়ি চলে যাই। তারপর যথারীতি চলে গেলাম।
অনেক বছর পর মা আমাকে নিয়ে এক বিছানায় ঘুমুতে বলেন। এটা-সেটা গল্প বলার পর মা আমাকে বলেন- তোর জন্য একটি পাত্র দেখছি। অবশ্য কথাবার্তা ইতোমধ্যে অনেক দূর এগিয়েছে।
আমি কোন কথা বললাম না। চুপচাপ শুনে যাচ্ছি।
মা বলে চলেন পাত্রটি খুবই ভালো। আমেরিকা ফেরত । উচ্চ শিক্ষিত। দেখতে খুবই সুন্দর এবং স্মার্ট। তোর সাথে বেশ মানাবে। এবার বিয়ে-শাদী করে দেশেই থেকে যাবে। তাছাড়া পরিবারটাও বেশ ভালো এবং সচ্ছল।
কথার পিঠে কোন কথা আমি বলছি না। কিন্তু মা বলেই চললেন- আগামীকাল তোর বাবা গিয়ে কথা বলে আসবেন। তারপর উনারা এসে তোকে দেখে যাবে।
মার আরও অন্যান্য কথা থেকে জানা গেল, ছেলে গত দশ বছর যাবৎ আমেরিকায় থাকে। বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে আটত্রিশ । বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। ছেলের মা চাচ্ছেন ছেলেকে বিয়ে-শাদী করিয়ে দেশেই আটকে রাখতে।
ছেলে আমাদের পাশের গ্রামের।
মার সব কথা শেষ হলে আমি বলি- এখন বিয়ে-শাদী করব না। আগে লেখাপড়া শেষ করি । তারপর যা বলবে সবই শুনব।
মা আমাকে আদর করতে করতে বললেন- লক্ষীসোনা আমার। ছেলেটা খুবই ভালো। না করিস না। বেশ টাকা-পয়সা আছে। তাছাড়া বিয়ের পর তোর লেখাপড়া তুই করে যাবি। এমন একটা পাত্র হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। বিদেশ ফেরত । দেখতে সুন্দর।
এসব জানাই কি যথেষ্ট? তাছাড়া ছেলের বয়স আমার দ্বিগুন হবে।-আমি মাকে বলি।
মা আমাকে বুঝানোর চেষ্টা করেন- ছেলেদের এই বয়স এমন কিছু নয়। বরং ওরা একটু সংসারী হয়। তুই অমত করলে তোর বাবা ভীষণ রাগ করবেন এবং আমিও খুব কষ্ট পাবো।
এতে রাগ করার কী আছে? আমি এখন বিয়ে-শাদী করবো না।- দৃঢ়কণ্ঠে বলার চেষ্টা করি।
বিয়েতে ছেলে-পক্ষের কোন দাবি-দাওয়া নেই। তুইতো বুঝতেই পারিস, তোর বাবার পক্ষে খরচপাতি করে তোকে বিয়ে দেয়ার মত সাধ্য নেই। তুই অমত করে তোর বাবাকে কষ্টে ফেলিস না।
মার কথা শুনে চুপচাপ শুয়ে থাকি। একসময় মা ঘুমিয়ে পড়েন। আর আমি সারারাত কান্নায় বুক ভাসাই।
পরদিন বাবা স্কুলে গেলেন না। ছুটি নিয়ে সোজা ছেলের বাড়ি গেলেন। বিকেল বেলা ফিরে এসে জানালেন, আগামীকাল আমাকে দেখতে আসবে।
আমার কোন না-ই বাবা কিংবা মা শুনলেন না। মা এবং বাবার ধারণা এর চেয়ে ভালো পাত্র আমার জন্য জুটবে না কিংবা জুটাতে পারবেন না। তারপর আমি নীরব থেকে গেলাম। আমার অমতেই ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল।
এটুকু বলার পর রুচিবার চোখে মুখে যেন রাজ্যের ক্লান্তি জড়িয়ে এল। চোখ ছলছল করছে। ঠোঁটের কাঁপন স্পষ্টই দেখতে পেল পারমিতা। পারমিতা একেবারে চুপচাপ । কথাগুলো শুনে ভীষণরকম খারাপ লাগছে। রুচিরা নিজেকে সামলে নিয়ে আবার বলে চলে- তুমি আমার ছোটবোনের মত। এরপরও তোমাকে বলব।
পারমিতা মাথা কাত করে ‘হ্যাঁ’ সূচক ইঙ্গিত দেয়।
বাসর রাতটা থাকে প্রতিটি মানুষের জীবনে স্মৃতিময় অধ্যায়। এই রাতটি নিয়ে মানুষ কত সুন্দর সুন্দর ছবি এঁকে রাখে। বাসর রাতের জন্য প্রতিটি মানুষের জীবন চলে অপেক্ষায় থাকা এককেটা প্রমময় মহাকাব্য। অথচ আমার জীবনটা বাসর রাতেই তছনছ হয়ে গেল। বিয়েটা অমতে হলেও অনেক কথা মনের ভেতর সাজিয়ে রেখেছিলাম বাসর রাতে বলব বলে। অথচ লোকটা বাসর কুঞ্জে ঢুকেই অশ্লীল হাত দুটো এলোমেলোভাবে আমার সারা শরীরে চালায়।
আপনি বাধা দিতে পারলেন না? রুচিরার কষ্টটুকু পারমিতাকেও যেন গভীরভাবে ছুঁয়ে গেল।
আর কিসের জন্যে বাধা দেব। আমার জীবনটাই তো ওর হাতের মুঠোর চলে গেল। ভাবলাম বিয়ে যখন হয়েই গেছে তখন সহ্য না করে উপায় নেই। তারপর লোকটা সারারাত নেকড়ের মত আমাকে খাবলে খাবলে উপভোগ করল। আমি নিরুপায় হরিণীর মত শুধু ছটফট করলাম। এভাবে প্রায় মাসখানেক চলল। আমার জীবনের সব রস, আনন্দ, স্মৃডু, দুমড়ে-মুচড়ে একাকার করে দিল। আমার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ স্পর্শে স্পর্শে নীল করে তুলল। সে কী বিভৎস স্মৃতি। মনে হলেই কষ্টগুলো চাড়া দিয়ে ওঠে হিংস্র নেকড়ের মতো।
শেষ রাতটিতে লোকটা যেন সত্যি সত্যি নেকড়ে হয়ে গেল। আমি ক্লান্ত। কষ্টে নিঃশ্বাসটুকু ফেলার মত অবস্থা আমার নেই। অথচ আমার কষ্টের নিঃশ্বাস থেকেও যেন লোকটা স্বাদ ছেকে নিতে লাগল। অবশ হয়ে এল আমার শরীর । ঘুমের রাজ্যে যেন তলিয়ে গেলাম আমি।
ভোর রাতে যখন চেতন ফিরল চেয়ে দেখি লোকটি চেয়ারে বসে সিগারেট ফুঁকছে। আমার জ্ঞান ফিরেছে টের পেয়েই কাছাকাছি হয়ে বসল। আমি চোখ জোড়া বন্ধ করে শুয়ে রইলাম। কোমর থেকে নীচ পর্যন্ত কোন অনুভূতি টের পেলাম না। সম্ভবত যন্ত্রণায় অবশ হয়ে গিয়েছিল নিম্মাংশ।
লোকটা ডেকে আমাকে বলে আমি আজই আমেরিকার উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছি। এই জীবনে তোমার সাথে আমার আর দেখা নাও হতে পারে। আমার ইচ্ছে নেই যদি-না ভাগ্য টেনে আনে।
আমি চুপচাপ শুয়ে থাকি। লোকটা বুঝতে পেরেছে যে আমি কিছুই বলব না। তাই আবার বলে চলে আমি আগেই বিয়ে করেছি। আমার তিন বছর বয়সী এক ছেলেও আছে। তোমাকে বিয়ে করার ইচ্ছে আমার ছিল না। আমার মা আমাকে জোর করে বিয়ে করিয়েছেন। অবশ্য বাবা থাকলে এই কাজটা করাতে সাহস করতেন না। যাই হোক, এসব বলে আর কোন লাভ নেই। আমি বাংলাদেশে থাকছি না, এটাই ফাইনাল। আমি কিন্তু আমার মাকে সব বলেছিলাম। এরপরও মা এমনটা করালেন। তোমার কিছু বলার থাকলে বলতে পারো।
আমি কিছুই বলতে পারি নি। মা-বাবার ওপর খুব রাগ হচ্ছিল। কতক্ষণ নিজে নিজে বিড়বিড় করলাম। লোকটার সাথে তারপর আর কোন কথা বললাম না।
যথাসময় লোকটা বিদায় নিয়ে চলে যায়। লোকটার মা-ও জানেন না যে, তার ছেলে চিরতরে চলে যাচ্ছে। কারণ সে তার মার কাছে বলে গেছে ক'দিনের জন্য ঢাকায় যাচ্ছে।
পারমিতা বলে ওঠে আপনি লোকটার মাকে সত্যি কথাটা বলে দিলেন না কেন?
রচিরা কণ্ঠটাকে একটু দৃঢ় করে বলে আমি ইচ্ছে করেই বলি নি। ভাবলাম বাকি জীবনটা পুত্রহীন কাটিয়ে কিছুটা হলেও যন্ত্রনা ভোগ করুক। কয়েকদিন পর অবশ্য সব বললাম। আমার কথা শোনার পর মহিলার সে কী কান্না! দু’দিন পর্যন্ত নাওয়া-খাওয়া করেন নি। আর তৃতীয় দিনে চেপে ধরলাম আমি।
মহিলা আমাকে বুঝাতে চেষ্টা করেছেন ছেলেকে কাছে ধরে রাখার জন্য এমনটি করেছি। অন্য কিছু ভেবে করিনি মা, তুমি আমাকে ক্ষমা কর।
আপনি আমার জীবনটাই নষ্ট করে দিয়েছেন। আপনি যে অপরাধ করেছেন তা ক্ষমার যোগ্য নয়। আমি আপনাকে কোনদিন ক্ষমা করতে পারবো না।
তার পরদিনই আমি চলে আসি। মা-বাবা আমার কথা শোনার পর হতবিহ্বল হয়ে যায়। কষ্টের সীমানা পেড়িয়ে আমি খুশী হওয়ার ভান করেছি শুধু মা-বাবাকে কষ্ট দেয়ার জন্য। কিছুদিন পর আমি নিজেই উকিল নোটিশ পাঠিয়ে দিই।
রুচিরার কথা শোনার পর পারমিতা যেন স্তব্ধ হয়ে যায়। কী বলবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠছে। তবুও অনেকটা সামলে নিয়ে পারমিতা বলে- যা হয়েছে তা-তো আর ফিরে পাবেন না। সব কিছু ভুলে যেতে চেষ্টা করুন। জীবনটাকে আবার নতুন করে সাজিয়ে তোলেন।
চেষ্টা তো করছি-ই ভাই। কিন্তু মনটাকে প্রবোধ মানাতে পারছি না।
0 মন্তব্যসমূহ