ডঃ গৌতম সরকার
ইউনিভার্সিটির শেষ বছরটা চোখের পলকে কেটে গেল, সাড়ে সর্বনাশের মতো পরীক্ষা দরজায় কড়া নাড়তে লাগলো ; টেনশন প্রচন্ড, প্রস্তুতি যে দারুণ হয়েছে সেটা আমার অতি বড় বন্ধু -শত্রু কেউই বলবেনা৷ তাই বিভীষিকাময় সেই দিনগুলোর কথা ভাবলে এখনো বুক কাঁপে৷ কিন্তু যত ভয়ংকরই হোক কালরাত্রিরও অবসান ঘটে, দীর্ঘ একমাস ধরে নাকানি চোবানি খাইয়ে একদিন সেই ম্যারাথন (নটা পেপার একসাথে ) পরীক্ষা শেষ হল৷ পরীক্ষা শেষের প্রাথমিক উন্মাদনা কাটার পর একটা দৃঢ় প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করলাম -পড়াশোনা আর নয়, অনেক হয়েছে আর যথেষ্ট হয়েছে......এবার আমাকে অন্য কিছু ভাবতে হবে, ভাবতেই হবে অন্ততঃ এই ভয়াবহ পড়াশোনার জগৎ থেকে রক্ষা পাবার জন্য৷ তাই কলকাতা ছাড়লাম না, কারণ এটা বুঝেছিলাম একবার গ্রামে ফিরে গেলে খুব ক্ষতি হয়ে যাবে, এখানে থেকেই কোলকাতার বন্ধুবান্ধবের সান্নিধ্যে ভবিষ্যৎ জীবনের রূপরেখাটির সন্ধানে লেগে পড়তে হবে৷
কিন্তু ওই যে বলে, 'Man proposes but God disposes', আর আমাকে চিরটাকাল বন্ধুদের ভালোবাসার সাথে সাথে অত্যাচারও সহ্য করতে হয়েছে ; আমি যখন মোটামুটি বইপত্র কেজি দরে বিক্রি করে দেবার ব্যাপারে ফাইনাল ডিসিশন নিয়ে ফেলেছি এমন সময় সোনালীর আবদার (অন্যথায় নির্দেশ ), 'এম ফিল টা ভর্তি হয়ে যা, তোকে ক্লাস করতে হবে না, তুই যা খুশি কর শুধু পরীক্ষাটা দিস৷ আমি তোকে সব মেটেরিয়ালস আর নোটস দিয়ে দেব '৷ প্রিয় বান্ধবীর কথা ফেলতে পারলাম না, কিন্তু মনে মনে বললাম - ওই ভর্তিই হলাম, পরীক্ষা দিতে বয়েই গেছে৷ ওপরওয়ালা তখন নিশ্চয়ই মুচকি হেঁসেছিলেন, তাই অন্য কোথায় সুবিধে করতে না পেরে ওই এম.ফিল. ডিগ্রীও গলায় ঝোলাতে হল৷ তখনও প্রাণপণে চেষ্টা করছি একটা চাকরির যেটা লেখাপড়া থেকে আমাকে শত সহস্র যোজন দূরে নিয়ে যাবে ; কিন্তু বছর তিনেক অমানুষিক পরিশ্রমের পর রীতিমতো ভালো চাকরির ফিনিশিং পয়েন্টের একদম হাত ছোঁয়া দূরত্বে দু -দুবার পৌঁছেও যখন মুখ থুবড়ে পড়লাম তখন চেতনায় ফিরলাম৷ বুঝলাম - that was not my cup of tea, তাই সুবোধ বালকের মতো- ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন !!!
এই সময় আমার জীবনের এক সংঘাতপূর্ণ সময়, বুঝে উঠতে পারছিনা কোন পথে এগোবো ! বাড়ির দায়িত্ব তেমন কিছু ছিলনা, কারণ বাবার পেনশন আর টুকটাক জমির কল্যাণে বাবা -মা আমার ওপর নির্ভরশীল নয়, বাদবাকি দায়িত্ব আমার অজান্তে আমার বড়দি কখন যেন নিঃশব্দে সমাধা করে গেছে৷ কিন্তু বুঝতে পারি সবাই আমার ব্যাপারে ক্রমশঃ চিন্তিত হয়ে পড়ছে ; তাদের দোষ নেই, তাদের ধারণা ছিল আমার মতো রত্ন অনায়াসে এবং অচিরেই স্বপ্ন আকরের সন্ধান পাবে এবং তাদের গর্বিত করবে, কিন্তু বাস্তবে তেমন কিছু ঘটলো না৷ কষ্ট বুকে নিয়ে এরা সবাই চুপ করে থাকতেন৷ এই সময় আবার বলতে হয় আমার সেই বন্ধুদের কথা, এর মধ্যে আমার ভাগ্য কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও আমাকে বিদ্যাদেবীর অনুগ্রহ থেকে মুক্তি দেয়নি ; এম. ফিলের পরই তুহিনদা (Prof. Tuhin Kumar Das, আমার এম ফিল, পি.এইচ.ডির গাইড ) একদিন ডেকে বললেন, 'গৌতম, তোমার এম. ফিল ডিসারটেশন বেশ ভালো হয়েছে, তুমি এটাকে বেস করে পি.এইচ.ডির জন্য এগিয়ে যেতে পারো'৷ অর্থাৎ আমার ইচ্ছে -অনিচ্ছাকে পাত্তা না দিয়ে অনেক আগেই আমার পি.এইচ.ডির রেজিস্ট্রেশন হয়ে গেছিলো ; তাই চাকরির জগতে প্রাথমিক ধাক্কা খেয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এতটুকু কষ্ট পেল না বা স্বপ্ন ভঙ্গের দীর্ঘশ্বাস ফেলল না -কারণ আবার তার বন্ধুরা তাকে নিজেদের উদারতায় কাছে টেনে নিল এবং আশ্চর্য্যজনক ভাবে সে সমস্ত বন্ধু ছিল ইংলিশ মিড়িয়ামের৷ ছেলেটি বন্ধুদের মহলে এক উষ্ণ-উত্তাল অভিনন্দন পেল ; পৃথিবীর ইতিহাসে আমিই বোধ হয় প্রথম ব্যক্তি জীবন যুদ্ধে হেরেও এমন সম্বর্ধনা পেয়েছিলাম৷ এখানে এবার শুধু সোনালী একা নয় তার সাথে যোগদান দিল জয়তী, নিবেদিতা, রঙিলী, রঞ্জনা ; এরা সবাই ওই সময়ে আমার পাশে না দাঁড়ালে আমার পক্ষে কখনোই কোলকাতায় থাকা সম্ভব হতনা৷ আমার তখন স্কলারশিপ ছিলনা, বাড়ি থেকে পয়সা নিতে খারাপ লাগতো, ওই সময় আমার বন্ধুরা বছরের পর বছর আমাকে টিউশন যুগিয়ে গেছে৷ কিন্তু এদের কৃতজ্ঞতা জানালে অপমান করা হয় কারণ এরা স্বার্থহীন ভাবে মানুষের জন্য করার শিক্ষা ছোটবেলা থেকে পেয়েছে ; গুরুজনদের সেই প্রাজ্ঞ শিক্ষা এদের ভালোবাসাকে কখনো বাংলা মিডিয়াম আর ইংলিশ মিড়িয়ামে ভাগ করতে শেখায়নি৷ আমি ভগবানের কাছে অশেষ কৃতজ্ঞ আমাকে সেই সময়ে এই পৃথিবীতে এনেছিলেন ; যে সময় মানুষ মানুষকে ভালোবাসতো, মানুষ মানুষের ভালো চাইতো৷ আজ যেটার বড় বেশি অভাব চতুর্দিকে চোখে পড়ে !!!
0 মন্তব্যসমূহ