সর্বশেষ

10/সর্বশেষ/ticker-posts

নতুন বছর



ইমরান হাসান কনক


মাথাতে হাত দিয়ে বসে আছে ‘হর’ চাষি হর, প্রতি বর্ষাতে যার ক্ষেত জুড়ে নতুন ফসল ফলতে শুরু করে, যখন চাঁদ ক্ষয়ে গিয়ে মহিষের শিং এর আকার ধারন করে তখন সে  ‘জেলেকা’(মাঘ-ফাল্গুন) সময়কালে ফসল বুনে, 

আর ফসল তুলে সে নতুন বছরের সময়ে, যখন আকাশে তারাদের মেলা বসে আর  চাঁদের পাশে তেরটি তারা তৈরি হয়, 

কিন্ত চাঁদ ,সে তো রমণী সে তো বড়ই চঞ্চল, তার উপরে ভর করে থাকতে গেলে পারে তার বিহি সে ফলাতে পারবেনা, সে জানে এটা,কিন্ত প্রতিবছর তো বন্যা আসে পৃথিবীর মাঝে সরস্বতী নদীর সাথে সাথে জাহ্নবী আর যমুনাও ফুলে উঠে এই চাঁদের কারনেই। 

যেমন নতুন কন্যা ঋতুমতী হয়, এই চাঁদের টানেই চলে আসে পলিমাটি আর সেই পলিমাটি দিয়ে হয় নতুন চাষ, কিন্ত এই বছর পলিমাটি নয় আসল অকালের বান, আর সেই বানে তার সমস্ত ফসল পুড়ে গেল যেন পানি না লাল ফুল দিয়ে সেগুলোকে স্পর্শ করা হয়েছে। এখন নতুন বছরের বাকি সময় টুকু ওই জঙ্গলেই চলে যেতে হবে বলে মনে হয়, নিষাদ আর আদিম প্রতিম জনগোষ্ঠী এর মত করে জীবিকা পালন করতে হবে, এমন না যে তার হাতের তীর কখনও ফস্কেছে তবে সে পছন্দ করে মাটির বুক থেকে ফসল ফলাতে, 

তার পাশেই আরেক কৃষক হেম এর ক্ষেত, হেমের ক্ষেত ভরে হয়েছিল অলাবু আর মরিচ, সব জ্বলে গেছে, কেমন করে যে জ্বল আগুন নেভায় সেই জ্বল আবার সব জালিয়ে দিতে পয়ারে সে সেটা জানেনা। 

বাড়ির দিকে রওনা হল হর, তার বিফল ব্যর্থ মনোরথ দেখে মনে হচ্ছে যেন  বিধ্বস্ত অবস্থাতে নিজের  ধ্বংসের দিকে চলেছে কেউ। 

তাকে পেছন থেকে ডাক দিল সাথী 

সাথী তার বধু , তার নারী 

তার পেছন থেকে দেওয়া ডাক কে অগ্রাহ্য সে করতে পারল না, 

“স্বামী , আপনি কোথায় যাচ্ছেন?” আদি কালের বউদের মত করে তার আকুতি ঝরে পড়ল। এখন তো আদিকালই এই সময়ে অনেক পূর্বের আর্য দের এখানে আসারও আগের। 

“হল, লাঙ্গল পুতে ভুমি থেকে ফসল ফলালাম, কোন দড়োমের পূজা ব্যর্থ হয়েছিল যে আমার এই ভুমি পূজন ব্যর্থ হল? তাই নিজেকে বোঙ্গা দেবতার অগ্নিতে বিসর্জন দিব আমি” 

বিহ্বল হয়ে চেয়ে রইল, “ মোর , মোর কি হবে স্বামী?” 

তুই অন্য পুরুষ নিস রে সাথী, 

আমার সহিত তোর এখান তকই, আর কোন বিহি নেই, কেমন করে বেঁচে থাকব আমরা? 

সারা আদাং এর কোথাও এক কনা খাবার নেই? 

সবাই এই গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে, কিন্ত আমি যেতে পারবোনা, তাই আমি এখানেই এভাবেই থাকব, 

যদি “তুই প্রাণ ত্যাগ করিস স্বামী! তবে জেনে রাখিস যে আমার শবও একদিন পরেই গঙ্গা দেবীর বক্ষে পাবি তুই দেখতে” 

“এই কথা বলিস না রে” 

তুমি তবে এমন কথা বলা বন্ধ কর। 

এই প্রথম তাকে একই সাথে তুমি আর তুই বলে ডেকেছে তার বউ 

তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, সুর্যদেব পাটে বসার উপক্রম। 

রাতের বেলা  তখন যেন শিবদেব তার জটার চুল ছড়িয়ে দেন আকাশে, সেই আকাশের নিচে চুমকির মত তারাগুলো জ্বলে, 

সেই তারজ্বলার মাঝে কুটিরে সে বসে আছে তার বউ কে নিয়ে, 

তার বউ এর চুল অবিন্যাস্ত, স্বামীর হাত বুলিয়ে দেবার ফসল। 

“তুমি ফসল ফলাতে পারো স্বামী, কেননা তোমার সোহাগের ফসল আমার এই গর্ভে আমি ধরে আছি”। 

হেসে উঠে বলল সাথী, 

“কি – কি বললি তুই?” 

হ্যাঁ গো হ্যাঁ, তুমি এবার রক্তের ফসল সিচবে এই কারণে হয়ত বিহি সিচতে পারোনি। 

অস্ট্রিক দের মত সহজাত নৃত্য প্রবন এক জাতির জন্য এটি এক নাচের সময়, আনন্দ মানেই নাচ, এই কারণে বউ কে কোলে তুলে নিয়ে খোলা পবনের মত নাচতে শুরু করল হর। 

“কিন্তক বউ, আমাদের কে সামনে এগিয়ে যেতে হবে” এখানে থাকলে আমার ছাওয়াল আর তুমি কেউই টিকব না, খালি মাছ খাইয়া কি করে হবে? 

চল তুই আমার লগে, 

স্বামী আর বউ মিলে হাটতে শুরু করে তারা, ছপ ছপ করে পানির ধারা কে অতিক্রম করতে থাকে তারা, আশেপাশে জলাভুমি ব্যাঙ ডাকছে, তার সাথে সাথে টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ার শব্দ। 

দুইজনে অন্ধকার আদাংকে পাশে রেখে এগুতে শুরু করে, হর আগে আর তার সাথে তার বউ, হরের পরনে নেংটি ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত তার বউ এর পরনে কটিবস্ত্র উপরে একটা কাঁচুলি, মনে হচ্ছে যেন দুই  কিশলয়ের লতা জড়াজড়ি করে একে অপরকে নিয়ে হেঁটে চলেছে।

আশেপাশে তাদের মতই আরও মানুষজন আছে, কারো ,মাথাতে একটা করে টুকরি কারো পাশে একটা বোঁচকা।  

ভোর হতে চলল, শিবের জটা থেকে ধীরে ধীরে সুর্য আবার আত্নপ্রকাশ করল,তারা সবাই হাটতে হাটতে পানিময় এলাকা পার করে এসেছে সামনের দিকে বড় বড় গাছপালা সম্পন্ন একটা বির(বন) এটা আদতে বীরভূম এর কাছাকাছি একটা জায়গা, অজয়ের তীর থেকে অনেক দূরে এগিয়ে এসেছে তারা। 

এই এলাকা উষর এখানে মরুর ন্যায়, হর নিজের জীবনে একবার মরু দেখেছে, 

সে গিয়েছিল, সুদূর পথ পাড়ি দিয়ে, গঙ্গাঋদ্ধি এর নৌকাতে করে সেই সরস্বতী নদীর তীরে, সেখানে মরুর বুকে আলো ঝলমল এক নগর সভ্যতা দেখে এসেছিল সে, মেলুহা। 

পূর্বে সে ছিল সৈনিক, মহিষারোহী। এই কারণে জম্বুদ্বীপের সপ্তসিন্ধু এলাকাতে গিয়েছে অনেকবার। তার মহিষ কালদূত কে সে উপহার দিয়ে এসেছিল তার বন্ধু শিবাকে, হরয়ঙ্কা নগরীতে থাকে সে। 

আবারও এক নদীর তীরে এসে দাঁড়াল তারা। তবে এই নদী অতটা প্রমত্তা নয়, যতটা তাদের অজয়। এই কারণে এখানে বসত করা যাবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা করতে বসল সে গোত্র প্রধান দের নিকট। 

যখন সে আলোচনা করতে শুরু করবে, তখনই সারি সারি নৌকার বহর দেখতে পেল সে নদীর পাড় দিয়ে, ডিঙ্গি তার পরিচিত, তবে এগুলো ডিঙ্গি নয় অনেক বড়। 

ধীরে ধীরে সবাই এসে পা রাখল, 

আচমকা কাছের জঙ্গল ভেঙ্গে এক বিশালদেহী মহিষ এসে তারা মাথার কাছে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। 

“আরে কালদূত, তুই এখানে কি করে” 

“আমার সাথে এসেছে!” দেখল ঝোপ ভেঙ্গে শিবা এগিয়ে আসছে, রক্তাপ্লুত অবস্থায় 

“শিবা, তর এই অবস্থা কে করল?” 

একদল লোক এসেছে আমাদের এখানে, সপসিন্ধুর পর্বত পাড়ি দিয়ে , এরা সংখ্যাতে অনেক, এদের সীমা করা যায় না, 

আমাকে একটু পানি দিতে পারবি ? 

‘দাঁড়া, আমি নিয়ে আসছি” 

অঞ্জলি ভরে পানি নিয়ে এসে সে দেখে তার বন্ধু আর এই পৃথিবীতে নেই। 

তার চোখ বেয়ে দুই ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ল, তার মনে হল যেন সেই সপ্তসিন্ধুর অশ্রু কোনভাবে গতকাল বৃষ্টি হয়ে পতিত হয়েছে তার গ্রামে। 

তার বউ কে বলল যে শিবা এর পরিবার এর খেয়াল রাখতে, গ্রামপতি এর কাছে দিয়ে গেল সে তার বউ আর বাচ্চা কে, 

এরপরে চড়ে বসল সে তার মহিষের উপরে, 

যারা সপ্তসিন্ধুর বিনাশ করেছে, তারা এখানেও এসে উপস্থিত হবে, এর পূর্বেই তাদের কে ধ্বংস করবে সে। 

বির হতে তার মহিষ তাকে পিঠে করে নিয়ে ছুটতে শুরু করল। 

নতুন বছরের প্রথম দিন এরকম ভাবেই সূচনা হল হর এর , পুনরায় তার যোদ্ধা হবার মাধ্যমে। 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ