সাদিয়া আফরিন প্রমা
উদাসীন চোখে তাকিয়ে আছে রহিমা।
হঠাৎ করে কাপড়টা ধরে ঝুলেই পড়ে একটি বাচ্চা ...
-"মা.. মা..আমায় একটা নতুন জামা কিনে দেবে মা...ওমা , বলো না দেবে কিনে মা?"
-"নতুন জামা?? ও তাইতো বৈশাখ আসছে যে...কিন্তু নতুন জামা কি করে কিনে দেবে সে।" বিরবির করে বলতে থাকে রহিমা।কিন্তু কোনো উত্তর দিতে পারে না। বোবা চোখে তাকিয়ে থাকে সে ছেলের দিকে। আর মন ?....মন তো চলে যায় অতীতে ..... তার ছেলেবেলায়....
ছোটবেলায় তার বাবা তাদের ভাইবোনের জন্য নতুন জামা এনে দিত।সেই জামা পড়ে সবাই মিলে বিকেলে বৈশাখী মেলায় যেত....কত মজা হত...আর আজ...!
সব ফাঁকা... ভাই বোনেরা সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে....আর মা বাবা তো কবেই চলে গেছে, তার সাথে শেষ হয়ে গেছে তার ভাগ্য...
খোকার বাবার সাথে সুখের সংসার ছিল তার। ট্রেনে হকারি করে যা রোজগার করতো চলে যেত টেনেটুনে, তবুও সুখ তো ছিল,শান্তি ছিল। সব দিনগুলো আজ ঝাপসা হয়ে আসে। আর দুই দিন পর বৈশাখ আসছে...অথচ আগের বৈশাখেই তো ওর জীবনে আঁধার ঘনিয়ে এসেছিল....সব কিছুই শেষ হয়ে গিয়েছিল.....
খোকার বাবা গত বছর পহেলা বৈশাখের দিন সকাল সকাল বেরিয়েছিল কাজে...তাকে বলেছিল তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে নিতে। তারপর তিনজন মিলে মেলায় যাবে...মানুষটা বেরিয়ে গেলে তাড়াতাড়ি কাজ সেরে ফেলে, খোকাকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে ...অপেক্ষায় থাকে খোকার বাবার জন্য...।
কই আসছে নাতো মানুষটা.... এই যে বলে গেল তাড়াতাড়ি ফিরবে।চিন্তা জাগে তার।না আর বসে থাকতে পারে না... বাইরে আসে...আবার ঘরে যায়...
কোথায় সে ...?? এক সময় ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে ঘরের বাইরেই...কি হল...! এরকম তো করে না মানুষটা ....দুচোখে চিন্তা ভাবনা নিয়ে অপেক্ষায় বসে থাকে সে....
দুপুর গড়িয়ে বিকেল...সন্ধ্যে থেকে রাত... খোকার বায়না মেলায় যাওয়ার...কিন্তু মানুষটার কি হল....??? দুচোখ ভরে যায় জলে...কোনো খবরও মেলে না।
তারপর খবর পেল...
হঠাৎ একটা লোক এসে জানালো খোকার বাবার কথা, একজনকে বাঁচাতে গিয়ে ওর পা দুটো..............
পুরোটা আর কানে ঢোকে না রহিমার..মাথা ঘুরে যায় তার...ঠিক শুনছে তো সে...হাসপাতালে ছুটে যায়...মানুষটা বিছানায় ...কেমন করে শুয়ে আছে খোকার বাবা... বুঝতে পারছিল না সারাজীবন এইভাবেই শুয়ে থাকতে হবে মানুষটাকে...দাঁড়াবার ক্ষমতা চিরকালের মতো শেষ হয়ে গেছে...পা দুটো যে আর নেই....কাঁদতেও ভুলে যায় রহিমা। ভবিষ্যৎ চিন্তা ভীড় করে মাথায়। কি হবে এখন....!
এই নববর্ষ ওর জীবনে এক আঁধার নিয়ে আসে....
বাড়ি ফিরে আসে খোকার বাবা। যে মানুষটা দৌড়ে কাজ করত, আজ সে বিছানায় শুয়ে আছে...রহিমা কাজ নিয়েছিল কটা বাড়িতে।সেই বাড়িগুলোর কাজ, নিজের সংসারের কাজ সময় যে কোথায় দিয়ে চলে যাচ্ছিল বুঝতে পারছিল না সে।ওষুধের খরচ, খোকার স্কুলের খরচ...আর এইসব করার পর বিলাসিতা করার পয়সা কোথায় পাবে ও...চমক ভাঙে খোকার ডাকে..."ও মা...দেবে কিনে... বিট্টু...রাহুল ওদের নতুন জামা হয়েছে ...ওরা দেখাচ্ছিল ...আমার হবে না মা....ওমা, বলোনা দিবেনা আমায় "???
দুচোখে জল নামে রহিমার। একবছর আগে যে সংবাদ শুনে ওর চোখ মরুভূমি হয়ে গিয়েছিল, আজ এই প্রথম জলে ভেসে যেতে লাগলো। মায়ের চোখের জল দেখে খোকা ঘাবড়ে গেল। ও বুঝতে পারছিল না কি হল মায়ের..! শুধু এইটুকু বুঝলো....ও অন্যায় আবদার করেছে...। ছোট্ট দুটো হাত দিয়ে মায়ের চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলল, "মা আমার জামা চাই না, কিছুই চাই না, আমি যখন বড় হবো তখন আমি বাবা আর তোমাকে সব কিনে দেব। শুধু তুমি কেঁদোনা মা।এই দ্যাখো আমি আর বায়না করছি না...শুধু তুমি কেঁদো না আর মা"...
রহিমা ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে ভাবে এই একবছরে এই নতুন বছর উপলক্ষে ছেলেটা অনেক বড় হয়ে গেল।সত্যিই বুঝি বড় হয়ে গেল,আর চিন্তা নেই।কাল সুমনাবৌদির থেকে কিছু টাকা ধার নেবে খোকার আর খোকার বাবার জন্য নতুন কাপড় কিনবে। এই বৈশাখ মাস এক নতুন ভাবে শুরু করবে সে। উঠে দাঁড়াতে হবে, খোকার বাবাকে ভরসা যোগাতে হবে, আর খোকাকে মানুষের মতো মানুষ করে তুলতে হবে। এবারের বৈশাখ থেকে এই জীবনের নতুন সংগ্রাম শুরু হবে রহিমার.......
ফার্মেসি অনুষদ- (৪র্থ বর্ষ),
ইউনিভার্সিটি অফ এশিয়া প্যাসিফিক ।
0 মন্তব্যসমূহ