ডঃ গৌতম সরকার
একটু একটু করে বড় হয়েছি আর একটা একটা করে ছোটবেলার ভালোলাগাগুলো হারিয়ে গেছে৷ আমি হিসেব কষে দেখেছি, একমাত্র দূর্গাপূজো ছাড়া বড়বেলায় ছোটবেলার আর কোনো ভালো লাগা অবশিষ্ট নেই৷ এটা কিছুটা হয়েছে প্রাকৃতিক নিয়মে আবার কিছুটা হয়েছে সচেতনে৷ আমার ছোটবেলা কেটেছে হুগলী জেলার পিয়াসারা গ্রামে, তারকেশ্বর (সবাই চেনেন) থেকে ৫-৬ কিলোমিটার ; সময়টা সত্তরের দশক আর আশির প্রথমভাগ৷ আমাদের না ছিল মোবাইল, ট্যাব, চ্যাটিং, স্মার্ট ফোন, আই ফোন - আবার তেমনি ছিল না ভিডিও পার্লার, মাল্টিপ্লেক্স, কে.এফ.সি, আই.পি.এল, ফেসবুক, ট্যুইটার ইত্যাদি ; কিন্তু আমাদের ছিল সবুজ মাঠ, পেট ভর্তি খিদে, বর্ষার কাদামাঠে ফুটবল পেটানোর আনন্দ, পাঁচ পয়সায় লাল-নীল-হলদে-গোলাপী আইসক্রিম খাওয়ার মজা, আলু ওঠার মরশুমে শুধু আলুরদমের ফিস্টিতে পেট ভরে আলুর দম খেয়ে বাড়ি ফেরা৷ আমরা আমাদের আনন্দের উত্সগুলো প্রকৃতি,পরিবেশ, সমাজ, সংসার থেকে খুঁজে নিতাম, প্রযুক্তি তখনও হাতে তুলে তেমন কিছু দেয়নি আর আমরা তাতে পাত্তাও দিতাম না৷ আমরা আমাদের মত করে নিজেদের নিয়ে ভালোই ছিলাম৷ আমাদের বাঁধন হারা আনন্দের সন্ধান দিত - পাড়া -বেপাড়ার মেলা, ফুটবল ট্যুর্নামেন্ট, স্কুলের ফাংশন, সরস্বতী পূজো, দূর্গাপূজো, যাত্রা - থিয়েটার, ফুটবল মাঠে চটের চাঁদোয়া খাটিয়ে সিনেমা দেখা৷ এরকম অনন্ত-অগণিত আনন্দানুষ্ঠান সারাবছর ধরে লেগেই থাকতো৷ তার মধ্যে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানটা ছিল বিশেষ ভাবে তাত্পর্যপূর্ণ কারণ এই অনুষ্ঠানে আমাদের মত ছোটোদের প্রত্যক্ষ যোগদান ছিল৷
ছোটবেলায় বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনটা আসার এক-দেড় মাস আগে থেকে আমাদের বর্ষবরণের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত৷ এই অনুষ্ঠানে মুলতঃ গান,আবৃত্তি,হাস্যকৌতুক হত আর অনুষ্ঠানের বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে থাকতো নাটক ; একদম ছোটবেলায় খেয়াল করতে পারি আলাদা করে ছেলেদের একটা আর মেয়েদের একটা করে নাটক হত৷ একটু বড় হবার পর ছেলেদের নাটকের কথা মনে পড়ে না, তবে মেয়েদের নাটক বেশ অনেক বড় বেলা পর্যন্ত দেখেছি৷ আমাদের বাড়ি এলাকায় সরকার বাড়ি বলে পরিচিত, আমাদের মূল বাড়ির বাইরেই আমাদের গ্রামের একমাত্র ক্লাব- ভারতী সংঘ, সারাবছর অনেক কর্মসূচীর মধ্যে পয়লা বৈশাখ উদযাপন একটা বিশেষ কর্মসূচি হিসেবে গৃহীত হত৷ গোটা অনুষ্ঠানটার প্রস্তুতি আর পরিচালনার দায়িত্বে থাকতেন পাশের পাড়ার এক দাদা, নাম বেচারাম ঘোষ - আমরা ডাকতাম বেচোদা৷ একই অঙ্গে এতো রূপ সত্যি আমি আমার অতটুকু বয়সে দেখিনি - একই ঘরে কাউকে হাতপা নেড়ে ‘বাবুদের তাল পুকুরে -হাবুদের ডাল কুকুরে' দেখিয়ে দিচ্ছেন, পরক্ষণেই মেয়েদের নাটকে হুবহু মেয়েদের গলা করে কোনো অভিনেত্রীকে কি পিচে ডায়ালগ বলতে হবে শিখিয়ে দিচ্ছেন৷ আবার সময় পেলেই পাশের ঘরে গিয়ে রবীন্দ্র সংগীতের রিহার্সালও দেখে আসছেন৷ আর গান, কবিতা, নাটক সব ব্যাপারেই প্রচন্ড নিখুঁত থাকতে চেষ্টা করতেন, কিন্তু একই সঙ্গে প্রচন্ড ফ্লেক্সিবেল ছিলেন, গ্রামের কচি -কাঁচাদের নিয়ে কিভাবে একটা অনুষ্ঠানকে উপভোগ্য করতে হয় উনি খুব ভালো ভাবে জানতেন৷ উনি নিজে খুব বড় শিল্পী ছিলেন, তাই ছোট ছোট বাচ্ছাদের ট্যালেন্টটা খুব সহজেই ধরতে পারতেন আর সেটার সঠিক প্রয়োগ ঘটাতেন৷ ফলস্বরূপ ওই সময়ও গ্রামের মানুষজন বেশ একটা উপভোগ্য বর্ষারম্ভের সাক্ষী থাকতে পারতেন৷
বেচোদা বিশেষ করে নাটকের ব্যাপারে একজন এক্সপার্ট ছিলেন, প্রতিবছরই নতুন নতুন উদ্ভাবনী শক্তির সাক্ষ্য রাখতেন৷ উনি নাটকের শুরুতে চরিত্রগুলোর পরিচয় করিয়ে দিতেন এক অভিনব কায়দায় ; ভাষ্যে থাকতেন নিজে, এক একটি চরিত্রের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিতেন তারপর সেই চরিত্র মঞ্চে ঢুকে কিন্তু হাঁসি মুখে ঘাড় ঝুঁকিয়ে দর্শকের অভিবাদন নিত না বরঞ্চ সে তার নাটকের গুরুত্বপূর্ণ কোনো এক ডায়ালগ অভিনয় করে দেখাত৷ তখন বুঝতে পারতাম না কিন্তু এখন বুঝি সেটা বেশ শক্ত ছিল৷ ভাবুন ফাঁকা মঞ্চে কোনো সহ অভিনেতা ছাড়া সেই একক অভিনয় করা মোটেই সহজ ছিলোনা, আর এখানেই ছিল বেচোদার কেরামতি৷ আর তার এই অভিনবত্বে নাটক শুরু হবার আগেই দর্শকেরা নাটকের কুশীলবদের সম্পর্কে একটা ফার্স্ট হ্যান্ড ধারণা পেয়ে যেত, যেটা পরবর্তীতে নাটকের মধ্যে পুরোপুরি অবগাহন করতে তাদের সাহায্য করত৷
আমি কখনও অভিনয় করিনি কিন্তু আমার দিদি-বোনেরা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ওনার শিক্ষণে অভিনয় করেছে এবং যথেষ্ট সুনাম অর্জনও করেছিল৷ আমার দৌড় ছিল ওই কবিতা পড়া পর্যন্ত, না সমস্ত কবিতাপাঠ আবৃত্তি হয়ে ওঠেনা৷ একদম ছোটবেলার কথা মনে নেই, তবে বেশ বড় বয়সে (সিক্স -সেভেনে ) রবীন্দ্রনাথের 'নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ' আবৃত্তি করার চেষ্টা করতে গিয়ে মাঝপথে মুখস্ত ভুলে ঘেমে-নেয়ে মঞ্চ থেকে নেমে এসেছি৷ কয়েকবার যে একেবারেই ওতরায়নি তা কিন্তু নয়, মাঝে মাঝে অল্পবিস্তর হাততালির মধ্যে উতরেও গেছি৷ সেই ভরসায় বা দাম্ভিকতায় একবছর ঠিক করলাম - ইংরেজি কবিতা আবৃত্তি করব, হুঁ হুঁ লোকজনকে বোঝাতে হবেনা আমি কত বড় দিগ্গজ !
কোন কবিতা এখন আর মনে নেই তবে বেশ বড় পোয়েম ; বেশ কয়েকদিন আগে থেকে ফাঁকা মাঠে, রাস্তা -ঘাটে, আয়নার সামনে, চার বছরের বোনকে সামনে বসিয়ে প্রশস্ত ছাদে গলা কাঁপিয়ে, কখনও গলা ছেড়ে, কখনো চাপা গলায় রিহার্সাল করে আশপাশের সবাইকেকে অতিষ্ট করে তুললাম৷ অবশেষে নিশি অবসানে বর্ষ শুরুর প্রারম্ভিক দিনটা এসে পড়ে৷ সকাল থেকেই শরীরটা কেমন যেন আনচান আনচান করে ; অন্যদিনের মতো খিদেটাও সেভাবে নেই৷ কিছুক্ষণ পর বুঝলাম প্রচন্ড ভয় লাগছে আর সব ভুলে যাচ্ছি৷ সকাল থেকে অনেকবার কসরত করে দেখলাম টেনশনের কারণে কোথাও না কোথাও আটকে যাচ্ছি, দুপুরে যখন বেচোদার কাছে ফাইনাল রিহার্সাল দিতে গেলাম, উনি সবটা শুনে বললেন, 'কবিতা হয়েছে তবে আবৃত্তি হয়নি’ , আবৃত্তি করতে গেলে আরোও প্র্যাকটিসের দরকার'৷ উনি এরকমই ছিলেন কাউকে আঘাত দিতেন না আবার সত্যি কথাটাও বলে দিতেন৷ আমার যা বোঝার বোঝা হয়ে গিয়েছিল, সন্ধ্যেবেলায় অনেক হালকা মনে মঞ্চে উঠে রবি ঠাকুরের 'আশ্বিনের মাঝামাঝি -উঠিল বাজনা বাজি' কবিতাটি পড়ে ( আবৃত্তি নয় ) দর্শকের আসনে গিয়ে বসলাম৷ ওই দিন সন্ধ্যায় আমাদের বাড়িতে একজন অতিথি এসেছিলেন, আমার বড়দিদির বন্ধুর হাসব্যান্ড, তিনি এসেছিলেন হঠাৎ করে, তিনি জানতেনও না আমাদের এই বর্ষবরণের অনুষ্ঠানের খবর৷ অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে হঠাৎ দেখি উনি মঞ্চে উঠেছেন, আর আমাকে মোহিত করে রবীন্দ্রনাথের এক অজানা কবিতা কোনোরকম প্রস্তুতি ছাড়া এত বাস্তবসম্মত ভাবে উদাত্ত কণ্ঠে আবৃত্তি করলেন, আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম৷ ওই বয়সেই একটা অতি বড় সত্যি আমার জানা হয়ে গেল- শিল্প অধ্যয়নের বিষয়, সেটা অর্জন করতে হয়, কারুকে দেখিয়ে আত্মোৎসুখ ভোগ করার ব্যাপার এটা নয়৷ এই বিষয়টাই বেচোদা নিজের মতো করে আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করতেন, কিন্তু কর্মকর্তা থেকে আমরা কেউ কি ওনার ল্যাঙ্গুয়েজ বুঝতে পারতাম না বুঝতে চাইতাম !
0 মন্তব্যসমূহ