সর্বশেষ

10/সর্বশেষ/ticker-posts

ভালোবাসার দ্বিতীয় প্রহর [পর্ব- ০৬]



পারমিতা এসে রুমে ঢুকেই জিজ্ঞেস করে একা একা কার সাথে কথা বলছেন?

পারমিতার উপস্থিতিতে রুচিরার তন্ময়ভাব কেটে যায়। তারপর বলে‘স্মৃতি নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম।

অফিসে যাচ্ছেন বুঝি? পারমিতা জানতে চায়।

বাম হাতে ছোট আয়নাটা ধরে রেখে ঠোঁটে লিপস্টিক রঙ লাগাতে লাগাতে রুচিরা বলে হ্যাঁ, অফিসে যাচ্ছি। ও হ্যাঁ পারমিতা, আজ সম্ভবত বেতনটা পাব। বেতন পেলেই তোমাকে আর সৈকতকে চাইনিজে নিয়ে যাব। তারপর নাটকপাড়ায় নাটক দেখতে যাব। পারমিতা খুশী হয়ে বলে- ঠিক আছে। রুচিরা ভ্যানিটি ব্যাগটা হাতে নিয়ে বাইরে পা বাড়ায়। পারমিতা সাথে সাথে হেঁটে চলে। বিল্ডিং-গেট পেরিয়ে একটু এগোতেই একটা মেয়ে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে বলে আজকের সাজগোজটা ভালোই হয়েছে। কাস্টমার বেশি জুটবে।

কথা বলার সাথে সাথেই অন্য মেয়েগুলো খিলখিলিয়ে হাসে একজন অন্যজনের ওপর গড়িয়ে পড়ছে। কথাগুলো রুচিরা স্পষ্টই শুনেছে এবং বুঝতে পেরেছে। আশেপাশে অন্য কেউ নেই। রুচিরার উদ্দেশ্যেই বলা সেটা ওর বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি। রুচিরা পারমিতাকে বলে- ওই  মেয়েটা কত নম্বর রুমে থাকে জান?

হ্যাঁ দিদি, জানি।- পারমিতা উত্তরে বলে।

রুচিরা কেন জানতে চেয়েছে তা ও বুঝতে পারেনি। কারণ একটু আগে যে কথাগুলো বলেছে ওই মেয়েটা তা পারমিতা শুনতে পায় নি বা লক্ষ্য করে নি। 

রুচিরা আর কথা বাড়ায় নি। গেইট পেরিয়ে গিয়ে রিকশায় উঠল রুচিরা। তারপর পারমিতাকে বলল- রাতে তুমি হলেই থেকো। আবার বাসায় চলে যেও না কিন্তু। কাজ আছে।

ঠিক আছে, বাসায় যাব না।

রিকশাওয়ালার পা চলতে থাকে। পারমিতা কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে আবার হলের ভেতর পা বাড়ায়।

*

পড়ার টেবিলে বসা অবধি লেখাপড়াতে মনটা ঠিকমতো বসাতে পারে নি পারমিতা। হৃদয়ের পুরো পৃষ্ঠা জুড়ে সৈকতের অবাধ বিচরণ। পারমিতার চোখের সীমানায় শুধু সৈকত। মনের অজান্তে সাদা পাতার বুক জুড়ে কলমের চিবুক বেয়ে নেমে এল সৈকত, সৈকত, সৈকত!  নামের উপরে আরও আঁকিবুকি করতে লাগল। মাঝেমাঝে নিজের নামটাও বসিয়ে দিচ্ছে। বসিয়ে  দিয়েই  পরক্ষণে নিজেই লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে। একটা ঘোরের মধ্যেই কেটে গেল পুরো সময়টা।

রুচিরা রুমে ঢুকেই দেখতে পায় পারমিতা মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করছে। কোনরকম শব্দ না করে চুপচাপ পারমিতার চেয়ার ঘেঁষে দাঁড়াল। খাতার পাশাপাশি চোখ পড়তেই ‘সৈকত’ লেখার পাশাপাশি ‘পারমিতা’ লেখা অক্ষরগুলো চোখ পড়ে। সাথে সাথেই রুচিরা বলে- সরি, আই অ্যাম রিয়্যালি সরি।

পারমিতা তড়িৎ গতিতে খাতাটা লুকিয়ে লজ্জাবনত দৃষ্টি নিয়ে রুচিরার দিকে তাকিয়ে বলে-আপনি কখন এলেন?

এইমাত্র এলাম। রুমে না গিয়ে সোজা তোমার রুমেই চলে এলাম। খাওয়া হয়েছে তোমার? পারমিতা অবাক চোখে ঘড়ির দিকে তাকায়। নয়টা বেজে পাঁচ । বেশ অবাকই হয় পারমিতা। তারপর অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করে- এত রাত হয়ে গেল কখন?

রুচিরা মুচকি হেসে কানে কানে বলে- সৈকত খুবই ভালো ছেলে। সৈকত ও তোমাকে খুব ফিল করে।

পারমিতা খুশী হয়েও যেন লজ্জায় ডুবে গেল। রুচিরার এক হাত টেনে ধরে বলে- চলুন আগে রাতের খাবার খেয়ে আসি।

খাওয়ার কথাটা মনে এলেই অরুচি এসে যায়।- এই কথা বলে পারমতিা রুচিরার দিকে তাকায়।

রুচিরা বলে- কী আর করা, চলো খেতে তো হবেই।

খাওয়া শেষ করেই রুচিরা বলে- বিকেলে যে মেয়েটার কথা বলেছিলাম ওই মেয়েটার রুমে চল।

পারমিতা কিছুটা অবাক হয়েই বলে- এখনই যাবেন। বিশেষ দরকার বুঝি?

রুচিরা পারমিতাকে বিকেলের ঘটনাটা বলে। কথাটা শোনার সাথে সাথে পারমিতা বলে তখন কিছু বললেন না কেন?

অফিসের দেরি হয়ে যেত, তাই। চল, এখন যাব।

দু’জন চুপচাপ হেঁটে চলে। দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। বেশ কয়েকটি মেয়ে রুমে বসে গল্প করছে। রুচিরাকে দেখামাত্রই ওই মেয়েটার চোখ-মুখ ফ্যাক্যাশে হয়ে গেল। সাথে অন্য যে মেয়েগুলো ছিল ওদের কেউ এখানে নেই। রুচিরা মেয়েটার উদ্দেশে বলে- আপনার সাথে কিছু কথা ছিল।

মেয়েটা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। তারপর এগিয়ে আসে রুচিরার কাছাকাছি। এরই মধ্যে মেয়েটা নিজেকে কিছুটা প্রস্তত করে নেয়। মুখমন্ডল কিছুটা শক্ত করে ফেলেছে। কাছে এসেই বলে- কী বলবেন বলুন।

রুচিরা রাগত অথচ শান্ত কণ্ঠে বলে আপনি বিকেল যে কমেন্টসগুলো করলেন তা কিন্তু ভীষণ রকম অপরাধ। 

মেয়েটির অস্বীকার করার চেষ্টা- আমি আপনাকে কিছুই বলি নি।

যদি স্বীকার করার সাহস-ই না থাকে তবে অনর্থক কথা বলেন কেন?- রুচিরা বেশ করেই চোখ রাঙ্গিয়েই বলে। 

বললাম তো আপনাকে আমি কিছুই বলি নি।

রুচিরা চোখ গরম করে বলে- আমাকে বলেন নি? আশেপাশে তো আর অন্য কেউ ছিল না। দেখুন বারবার এক কথা বলবেন না। বললাম তো আপনাকে আমি কিছুই বলি নি।

তর্কাতর্কি শুনে রুমের অন্যান্যারা এগিয়ে এল। কিন্তু কেউ কিছু বলছে না। রুচিরা এবার আঙুল উঁচিয়ে বলে-  স্বীকার যখন করছেন না তাই কিছু বললাম না। নইলে টের পাইয়ে দিতাম।

এবার মেয়েটা উত্তেজিত হয়ে বলে- বলেছি, কী করবেন আপনি?

রুচিরা হাত বাড়িয়ে এগিয়ে যায় মেয়েটির দিকে। অন্য মেয়েরা সবাই মিলে ফিরিয়ে রাখে। পারমিতাও রুচিরাকে জড়িয়ে ধরে বলে শান্ত হোন রুচিদি, শান্ত হোন। ওই মেয়েটাও গরম হতে যায় কিন্তুু পরক্ষণই শান্ত হয়।

মেয়েগুলোর মধ্যে একজন বলে- ঘটনা কী হয়েছে আগে ভালো করে জানি, তারপর সমাধান করা যাবে। দিদি ভেতরে আসুন।

রুমে ঢুকতেই রুচিরাকে একটা চেয়ার এগিয়ে দিল। চেয়ারে বসেই রুচিরা মেয়েটিকে বলে - আপনি আমাকে কতটুকু চেনেন বা জানেন?

মেয়েটা চুপচাপ।

কারও সম্পর্কে কিছু বলতে হলে আগে জেনে নিন ওই ব্যক্তিকে । শুনবেন আর বিশ্বাস করবেন এটা কিন্তুু ঠিক নয়। রুচিরার কণ্ঠে হালকা রাগ ছড়িয়ে পড়ল।

মেয়েটি একপলক তাকিয়েই আবার চুপচাপ।

হ্যাঁ আছে, কিছু মেয়ে আছে যে হোটেলে যায়। আচ্ছা ধরুন আমিই যাই। কথাটা শুনে মেয়েটা রুচিরার দিকে আশ্চর্য দৃষ্টি নিয়ে ফিরে  তাকায়। রুচিরা বলে চলে আমি যাচ্ছি কেন যাচ্ছি বা কেন বাধ্য হলাম এ জঘন্য কাজে যেতে সেটি কী কোনদিন জানতে চেয়েছেন কারও কাছে? উত্তরের অপেক্ষা না করে রুচিরা নিজেই উত্তর দেন- অবশ্যই করেন নি। শুধু শুনেছেন আর সেই ধারণাটাই চাপিয়ে দিচ্ছেন। সামাজিক কোন দায়িত্ববোধ কি আপনার নেই?

অবনত হয়েই মেয়েটি নখে বিছানার চাদর খুটছে। রুমের ভেতর কারও মখে টু শব্দটি নেই। পিনপতন নীরবতা ভেঙে রুচিরা বলে- প্রতিটি মেয়েই তার সম্ভ্রমকে জীবনের পরম সম্পদ ভাবে। সুস্থ জীবন থাকতে এই সম্ব্রম কেউ হারাতে চায় না। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লেভেলে  যারা আসে তারা নিশ্চয়ই ইম্ম্যাচিউরড নয়। তারা নিজেদের ভালো-মন্দ বোঝে। যদি  কিছু বলার ইচ্ছেই হয় তবে ওদের সাথে সরাসরি কথা বলেন। জানতে চেষ্টা করেন, এটা আপনার সামাজিক দায়িত্ব।

মেয়েটি এবার বিনম্র দৃষ্টিতে তাকায় এবং বলে সরি দিদি, এমনটি আর কখনও হবে না।

রুচিরা চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে মেয়েটির পিঠে হাত রেখে বলে- ভুল তো মানুষেরই হয়। আর শোন আমি আড়ংয়ে পার্ট-টাইম চাকরি করি। টাকার দরকার তাই আমাকে চাকরিটা করতেই হয়।

মেয়েটি এবার রুচিরাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদু কাঁদু কণ্ঠে বলে- আমার ভুল হয়ে গেছে দিদি, আমাকে ক্ষমা করে দিন।

মেয়েটিকে বুকে টেনে নিয়ে রুচিরা বলে- ঠিক আছে, তুমি তোমার ভুল বুঝতে পেরেছ সেটাই যথেষ্ট। একথা শেষে রুচিরা পারমিতাকে ডেকে বলে- পারমিতা উঠ, যাওয়া যাক।- এই বলে দরজার দিকে পা বাড়ায় রুচিরা। পিছু পিছু পারমিতা। মেয়েটিও এগিয়ে আসে। তারপর বলে দিদি, আবার আসবেন কিন্তু।

রুচিরা মিষ্টি হাসি হেঁসে সামনে পা বাড়ায়।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ