ডঃ গৌতম সরকার
চাকরি জীবনের প্রথম এগারোটা বছর কেটেছে মফঃস্বলে, মফঃস্বল হলেও বেশ বর্ধিষ্ণু মহুকুমা শহর, সর্বোপরি বর্ডার টাউন৷ কিন্তু কলেজটা ছিল মূল শহর থেকে বেশ কিছুটা ভেতরে ইছামতি নদীর ধারে৷ সিনিয়র কলিগদের কাছ থেকে জেনেছি, প্রাচীন চিন্তনে শিক্ষার পীঠস্থান হবে লোকালয় থেকে দূরে প্রকৃতি, অরণ্য, নদীর বুকে, যেখানে নাগরিক সভ্যতার কোনরূপ হাতছানি চিন্তা ও মননে ব্যাঘাত ঘটাতে পারবেনা৷ কিন্তু আমাদের মতো আধুনিকতার ধ্বজাধারীদের কাছে আড়াই ঘন্টা ট্রেন জার্নি শেষে সাইকেল ভ্যানে বা রিকশায় সাড়ে তিন কিলোমিটার রাস্তা পেরোনো বড়ই ক্লান্তিকর মনে হত৷ সত্যি কথা বলতে কি এটা শারীরিক এবং পকেটিক উভয় দিক থেকেই বেশ অপছন্দের ছিল৷ কলেজের স্থানগত অসুবিধার কারণে মূল শহর বা আশপাশের শহরের ছাত্রদের আমরা সেভাবে পেতাম না, ভালো স্টুডেন্টদের স্বাভাবিক ভাবে কলকাতা শহর টেনে নিত ; তাই আমরা মুলতঃ ছাত্র-ছাত্রী পেতাম আরোও পিছনের প্রত্যন্ত গ্রামগুলি থেকে৷ সহজ -সরল সেই সব ছেলে -মেয়েদের গা থেকে মাটির গন্ধ ভেসে আসত, অধিকাংশই প্রথম জেনারেশন শিক্ষার অঙ্গনে পা রেখেছে -এদের নিয়েই ছিল আমাদের সংসার৷ তাই ওই সময়েও বাংলা বনাম ইংরেজি মিডিয়ামের দ্বন্দ্ব কোনোভাবেই অনুভব করিনি৷ ব্যক্তিগত ভাবে আমার বিষয়ের ছাত্র -ছাত্রী ওখানে তেমন পাইনি, তখন স্কুল সার্ভিস কমিশনের রমরমা বাজার, স্বাভাবিক কারণেই তারা এমন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করত যাতে গ্র্যাজুয়েশনের পরপরই চাকরির পরীক্ষায় বসতে পারে৷ তবে একটা ব্যাপারে খুব খারাপ লাগতো যে এদের ইংরেজির প্রাথমিক জ্ঞান ছিল খুব খারাপ৷ এর জন্যে অনেকটাই তত্কালীন শিক্ষাপদ্ধতি দায়ী হলেও নিজেদের দায়বদ্ধহীনতাও অনেকটা দায়ী ছিল বলে আমার মনে হয়েছিল৷
এরপর এলাম কোলকাতার তথাকথিত এক কুলীন কলেজে পড়াতে ; এখানে এসেই প্রথম অনুভব করলাম বাংলা আর ইংরেজি মাধ্যমের প্রবল সংঘাত, যেটা আমাকে বেশ ধাক্কা দিল৷ আমার গোটা জীবনে সব কিছু এতো স্বাভাবিক ভাবে ঘটে গেছে, বাংলা মিডিয়ামে পড়াশোনা করে এসে কোথাও এতটুকু হোঁচট খেতে হয়নি ; কিন্তু এতদিনকার বিশ্বাস বা ধ্যানধারণা বেশ ধাক্কা খেল এই কলেজে এসে৷ প্রথমদিন থেকেই চোখে পড়ল এই বাংলা ইংরেজির দ্বন্দ্ব৷ ক্লাস শুরুর কয়েকদিনের মধ্যেই দেখলাম একটা ক্রিটিক্যাল ডায়েকটমি তৈরী হয়ে গেছে ; ক্লাস ঘরে ওরা আলাদা আলাদা ভাবে উলম্ব অক্ষে ভাগ হয়ে গেছে, আমি কখনো একজন ইংলিশ মিডিয়ামের মেয়েকে বাংলা মিডিয়ামের কোনো মেয়ের সাথে বন্ধুর মতো কথা বলতে দেখিনি৷ আবার বাংলা মিডিয়ামের মেয়েদের দেখেছি ইংরেজি মাধ্যমের মেয়েদের সান্নিধ্যে শক্ত মুখে অন্য দিকে চেয়ে বসে থাকতে ; অনেক সময় এমন হয়েছে আমি কোনো মেয়েকে কিছু একটা ইনফরমেশন ক্লাসের সবাইকে শেয়ার করতে বলেছি, সে কিন্তু বেমালুম তার পছন্দের (মিডিয়ামের) বন্ধুদের বলে কর্তব্য শেষ করেছে৷ পরে জেনে খারাপ লেগেছে, হয়ত ডেকে বকাও দিয়েছি, কিন্তু আমার দিক থেকে আপ্রাণ চেষ্টার পরও কোনোভাবেই সেই দূরত্ব মেটাতে পারিনি, সেটা আমি আমাদের মতো শিক্ষকদের অপারগতা ছাড়া আর কি বলতে পারি !
সিলেবাসের চাপে বা ছাত্রীদের চাহিদায় অনেক সময় বাড়িতে স্পেশাল ক্লাস (অনুগ্রহ করে এটাকে টিউশন মনে করবেন না) নিতে হয়, ওখানেও দেখেছি কাউকে আমি বা কেউ নিজে কোনও ক্লাসে আসতে চাইছে তার আগে তাদের অবশ্য জিজ্ঞাস্য হল ওই নির্দিষ্ট গ্রুপে আর কে কে জয়েন করেছে, অর্থাৎ ওর কতজন বন্ধু (মিডিয়ামের ) ওই গ্রুপে আছে৷ এখানেই আমার নিজেকে খুব হেরো মনে হয়, শিক্ষক হিসেবে অবশ্যই অসম্পূর্ণ যদি মেনে নিই একজন শিক্ষকের দায়িত্ব হল মানুষ বানানো, কেবলমাত্র ডিগ্রী জোটানোর কারিগর নয়৷
আত্মকেন্দ্রিকতা, আপন পসন্দ, আত্মম্ভরিতা, আপনি কোপনি এই প্রজন্মের মন্ত্র৷ সেখানেই আমাদের পরাজয়, অক্ষমতা, দায়িত্বহীনতা আর পালিয়ে যাবার মানসিকতা৷ তাই ভাবার অনেক জায়গা রয়ে গেছে, যত ভাববো ততোই মঙ্গল৷ কেবলমাত্র বাচ্ছাগুলোর ওপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে আমরা আমাদের দায়িত্ব কি বিন্দাস এড়াতে পারি !
----------------------------------------------------- (শেষ)
0 মন্তব্যসমূহ