ফারিহা ফারজানা অরণী
বীরসিংহ গ্রামটা দু'টি কারণে লোকমুখে বিখ্যাত। এক, এই গ্রামে প্রতি বৈশাখে বায়োস্কোপ নিয়ে বসেন শ্যামল চাচা। দুই, এই গ্রাম একদম নদীর শেষ মাথায়, ভাঙনের জন্য সদাপ্রস্তুত থাকতে হয়। যখন-তখন নাও নিয়ে এই গ্রামের মানুষ পাশের গ্রামগুলোতে উপস্থিত হয়। তখন তাদের আশ্রয় দিতে হয়।এমনিতে এই গ্রামের মানুষগুলো মাটির মানুষ। কোন দলাদলি নাই। দিন শেষে পেটে দানা-পানি ঠিক মত পরলেই খুশি। পেট ঠান্ডা তো জগৎ ঠান্ডা, এই তাদের নীতি।
বাদলের ক্লাস থ্রি পেরিয়ে ফোরের ক্লাস শুরু হয়েছে। এখন তো আম-কাঠালের ছুটি। গরমের ছুটি। বাদল অনবরত মাঠে খেলে, দৌড়ে বেরায়। বাড়িতে ফিরলেই মা এটা সেটা করতে দোকানে পাঠায়, নাহলে হালকা কাজ ধরিয়ে দেয়। আজকেও এক হালি ডিম আর কিছু ধনে পাতা আনতে বাজারের দিকে পাঠিয়েছিল। অবশ্য তখন বাজারের কাছে ভীর। শ্যামল চাচার বায়োস্কোপটা নেশার মত টানে বাচ্চাদের। কমলা সুন্দরীর কিচ্ছা, রূপাই এর গল্প আরো কত কি। শ্যামল চাচা ইদানিং কি কি যেন বলেন। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে। দেশে নাকি আগুন জ্বলবে। আমাদের না কি আমাদের অধিকার দিচ্ছে না কারা। মিলিটারি, সামরিক শাসন, সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট এইসব শব্দ নতুন, বোঝেও না কিছু বাদল। কিন্তু ওই যে বায়োস্কোপের শেষে মাঝে মাঝে মাঝখানে হলুদ ম্যাপ আর লাল বৃত্ত, বাইরে সবুজ, সেই পতাকাটা দেখিয়ে যখন বলে শ্যামল চাচা, "কয়া দিলাম দেহিস, এই পতাকা আমাদের অইব!" তখন অন্যরকম একটা শিহরণ জাগে মনে। কেন জাগে ঠিক বুঝতে পারে না বাদল, সে শুধু জানে, এই অনুভূতিটা শুদ্ধ। মন থেকে আসে, ভেতর থেকে আসে।
হঠাৎ এক দমকা হাওয়ার মতন চারিদিকে যুদ্ধের দামামা বাজে। বীরসিংহ গ্রামেও ছড়িয়ে পরে এই শিখার তাপ। বাদল আর দেখতে পায় না শ্যামল চাচাকে। শ্যামল চাচা একদিন গোপনে বায়োস্কোপটা নিয়ে জংলা বাড়ির দিক পার হচ্ছিলেন। দৌড়ে যেয়ে চেপে ধরে বাদল। শ্যামল চাচা বর্ডার পার হয়ে ইন্ডিয়া যাচ্ছেন ট্রেনিং নিতে। ছোট একটা পতাকা বের করে দেন বাদলকে। বাদল সেইদিন ছোট্ট হাতে পতাকা নিয়ে বলেছিল, "আমারে দেন চাচা। আমি বুকের সাথে মিশাইয়া রাখুম কেউ টের পাইব না।" গেঞ্জির ভেতরে বুকের সাথে মিলিয়ে রেখেছিল পাতাকাটা।
আজ সেই বুক প্রশস্ত হয়েছে। বাদল সাহেব এখন "শহীদ শ্যামল সেন উচ্চ বিদ্যালয়" এর হেডমাস্টার। আজকে স্বাধীনতা দিবসের পতাকা উত্তোলন। ছাত্র-ছাত্রীরা সবাই লাইন করে মাঠে দাঁড়ানো। পতাকা উত্তোলিত হচ্ছে একটু একটু করে। পতপত করে উড়ছে বাতাসে। কতটা দাম এই পতাকার? রক্ত দিয়ে কেনা এই পতাকা। শ্যামল এর মতন হাজারো বীরের রক্তে।
ফার্মেসি অনুষদ, চতুর্থ বর্ষ
ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক
0 মন্তব্যসমূহ