সর্বশেষ

10/সর্বশেষ/ticker-posts

নিবন্ধ-মধুসূদনের কাব্য প্রতিভা ।

 

 টুলটুল দেবনাথ (শিপ্রা)
 
ছাত্রজীবন থেকেই মাইকেল নিজের কবি শক্তির পরিচয় দিয়েছিলেন। কবি প্রধানত ইংরেজি ভাষাতে কবিতা রচনা করতেন এবং একদিন তিনি মহাকাব্য রচনা করতে সক্ষম হবেন বলে মনে করেছিলেন। সে সময় রিচার্ডসন তার কবিতা পড়ে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছিলেন। ভূদেব মুখোপাধ্যায় ছিলেন মধুসূদনের বন্ধু এবং তিনি স্বীকার করে গিয়েছেন যে ইংরেজি সাহিত্যে তাদের সময়ে কোন ছাত্রই মধুসূদনের সমকক্ষ ছিলেন না।
কলেজ জীবনে কবি তার এক বন্ধু কে বলেছিলেন, 'I happened to be a great poet, with I am almost sure I shall be'. তার এই কথা পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয়েছিল।আ ১৮৪৩ সালে তিনি আত্মীয়-স্বজন পিতা-মাতা কাউকে না জানিয়ে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে মাইকেল নামে অভিহিত হন। ফলে তিনি হিন্দু কলেজে পড়ার অধিকার হারান এবং পরে Bishop's কলেজে ভর্তি হন। তারপর ১৮৪৮সালে একদিন সকলের অজ্ঞাতসারে মাদ্রাজে চলে আসেন। মাদ্রাজে তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন পাশাপাশি ' পত্রিকা পরিচালনার কাজ হাতে নেন।মাদ্রাজে থাকাকালীন সময়ে তিনি তামিল,তেলেগু, গ্রিক ও হিব্রু ভাষার উপর অধিকার অর্জন করেন। পূর্বে তিনি সংস্কৃত ইংরেজি এবং ফরাশী ভাষাতেও বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। মাদ্রাজ থেকে প্রকাশিত 'Madras Circulator' Magazine 
এ মধুসূদন দত্ত 'Timothy pen poem' ছদ্মনামে A Vision Captive Lady' শীর্ষক একটি ইংরেজী কাব্যে পৃথ্বীরাজ সংযুক্তার কাহিনী তুলে ধরেন। সময়টা ছিল ১৮৪৮-১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দ ।তিনি এই কাব্য রচনা করে অনেকটা খ্যাতি লাভের আশা করে থাকলেও ফল হলো তার বিপরীত। তার উপর ইংরেজ সম্পাদকের কাছে অনেক ভর্তসিৎ হন। পাশাপাশি বেথুন সাহেব মধুসূদনের কাব্য পাঠে তার প্রভূত প্রশংসা করে থাকলেও গৌড় দাস লিখেছিলেন যে,মধুসূদন যদি মাতৃভাষার শ্রীবৃদ্ধির জন্য তার প্রতিভা নিয়োজিত করেন তবে তিনি স্বদেশের ও উপকার করবেন এবং নিজেও সুখ্যাতি লাভ করবেন।গৌরদাস বসাক একথা বন্ধুকে জানিয়ে দিয়ে বেথুন সাহেবের সাথে সহমত হয়ে মধুসূদনকে বাংলা কাব্যে অবতীর্ণ হতে অনুরোধ করেন।

১৮৫৬ সালে মধুসূদন কলকাতায় ফিরে আসেন। সে সময় তিনি বেলগাছিয়া নাট্যশালা সংস্পর্শে আসেন।তখন তিনি এখানে "রত্নাবলী" নামের সংস্কৃত নাটকের বাংলা অনুবাদ মঞ্চস্থ হতে দেখে বাংলা নাটক সম্বন্ধে অবগতি লাভ করেন।১৮৫৯সালে আকস্মিক বাংলা সাহিত্য জগতের আত্মপ্রকাশ করেন "শর্মিষ্ঠা" নাটক রচনার মধ্য দিয়ে। শর্মিষ্ঠা নাটকটি বাংলা সাহিত্যে প্রথম পাশ্চাত্য ধর্মী নাটক বলে মনে করা হয়ে থাকে। উক্ত নাটকটি বাংলা সাহিত্য জগতে এক ঐতিহাসিক আলোড়ন সৃষ্টি করে। রাজা প্রতাপ চন্দ্র, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ এই নাটক খানির ভুয়সি প্রশংসা করেন।

তারপর তিনি দুখানি প্রহসন রচনা করেন ১৮৬০ সালে "একেই কি বলে সভ্যতা" এবং "বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ"।মধুসূদন বাংলা নাটক রচনা করতে গিয়ে বীর রস প্রকাশের উপযোগী ভাষার অভাব বোধ করেন এবং স্বতঃস্ফূর্তভাব বহনকারী ছন্দের অভাব বোধ করেন। তারই অভাব দূর করতে গিয়ে পদ্মাবতী নাটকে ব্যবহৃত "অমিত্রাক্ষর" ছন্দের সৃষ্টি করেন। তারপরেই তিনি মহাকাব্য রচনায় এবং অমিত্রাক্ষর ছন্দের শক্তি পরীক্ষার জন্য তিনি তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য নামে মহাকাব্য জাতীয় একটি খণ্ড কাব্য রচনা করেন এবং এটি ছিল বাংলা ভাষায় অমিত্রাক্ষর ছন্দের দ্বিতীয় কীর্তি। তারপর ১৮৬১ সালে মধুসূদন লিখলেন বাংলা সাহিত্যের অমিয় অমর মহাকাব্য "মেঘনাদবধ" কাব্য। এই কাব্যটি কবির অক্ষর কীর্তির স্তম্ভ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে নব্য যুগের কবি সাহিত্যিকদের কাছে।কবিকে সাহিত্যের স্বর্ণ শিখরে পৌঁছে দিয়েছে তার এই মহাকাব্য রচনা। "Literary Epic"এর বর্ণনাভঙ্গি ও ভাষার অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটেছে এই কাব্যগ্রন্থে।
  
ন্যায় নীতি ও কল্যাণ বোধ মহাকাব্যিক বিশালতা গাম্ভীর্যতা এবং সমুন্নতি ও উদারতার মত লক্ষণগুলি সাবলীল ভাবে প্রকাশ পেয়েছে এই কাব্যে।
মধুসূদন জন্মেছিলেন কাব্য সৃষ্টির জন্য। মহাকাব্য লেখার পরও তার গীতিপ্রবন কবিমন যথার্থ তৃপ্তি লাভ করতে পারেনি ফলপ্রসূত মহাকাব্য রচনার পরেই ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে তিনি লিখে ফেললেন "ব্রজাঙ্গনা" কাব্য। চলতি বছরেই আরেকটি বিয়োগান্তক নাটক রচনা করেন যার নাম "কৃষ্ণকুমারী"।মেঘনাদবধ কাব্য রচনা করে মধুসূদন অমিত্রাক্ষর ছন্দের যথার্থ শক্তি উপলব্ধি করেন। বীর রস ব্যতীত অন্য সমস্ত রসই যে সহজে এই ছন্দকে বহন করে প্রকাশিত হতে পারে তার উপযুক্ত প্রমান হলো বীরাঙ্গনা কাব্য। বাংলা ভাষাতে এটি কবির পত্রকাব্য রচনার সার্থক নিদর্শন। এই কাব্যে কবির অমিত্রাক্ষর ছন্দ পরিপূর্ণতা লাভ করেছে।

১৮৬২ সালে ব্যারিস্টারি পড়তে তিনি বিলাত গমন করেন এবং কিছুদিনের মধ্যেই অর্থাভাবে পড়ে ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে গিয়ে পৌঁছান। সেখানে তিনি আত্মীয়-স্বজনের অভাব বোধে এবং স্মৃতি রোমন্থন করার ফলে সৃষ্টি হলো তার চতুর্দশ পদী কবিতাবলী। ১৮৬৬ সালে ব্যারিস্টারি পাস করে ১৮৬৭ সালে তিনি কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন।স্বদেশে ফিরে অর্থকষ্টের সম্মুখীন হলে তিনি আবার সাহিত্য সৃষ্টিতে মনোনিবেশ করেন।হোমারের ইলিয়াড কাব্যের অনুবাদ গদ্য ভাষায় লিখলেন।হেক্টর বধ পর্বের মায়াকানন নামের নাটক খানিও ট্রাজেডি নাটক হিসেবে উল্লেখিত হয়। গতিকে মধুসূদনের আবির্ভাব বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল ধূমকেতুর মতো আকস্মিক। মধুসূদন বাংলা কাব্য সাহিত্যে বহুবিধ ধারার এবং আধুনিকতার প্রবর্তক। তার জন্মকালীন সময় ছিল বাঙালির কাছে এক অন্ধকারাচ্ছন্ন কাল।

নতুন এর সাথে পুরাতনকে মিলিয়ে গ্রহণ না করাই ছিল বাঞ্ছনীয় সে যুগে।কেননা সেকালে একদিকে নতুন শাসকের সামাজিক অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পদক্ষেপের জন্য পুরনো সমাজ এবং অর্থনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল।ইংরেজদের সংস্পর্শে এসে বাঙালি এক নতুন উন্মাদনা অনুভব করে আবিষ্কার করল নিজেদের চারপাশকে। বাংলা কাব্যজগতে মধু কবি বিভিন্ন রিতীর প্রবর্তক। তিনি বাংলা কাব্যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য আঙ্গিকের সমন্বয় সাধন করেছেন। শুধু ছন্দেই নন অলংকার এর প্রয়োগে ও তার কাব্য মহানতা লাভ করেছে। বাংলা সাহিত্যে তিনি আধুনিক মহাদেশের আবিষ্কার করেছেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে উঠে নব্যাঙ্গিক সাহিত্য পরম্পরা। বাংলা সাহিত্যে তাঁর রচিত আধুনিক মহাদেশের আবিষ্কারের জয়মাল্য চিরকাল তার গলে অম্লান হয়ে থাকবে।স্মরণীয় সকল বাঙালি নামের সাথে মধু কবির নামেও বঙ্গদেশ চির ধন্য এবং গর্বিত।

কলকাতা,ভারত ।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ