ডা ঃ গৌতম সরকার
পর্ব- ১
চতুর্দিকে এত সতর্কীকরণ , ভয় , বাধানিষেধ, আতঙ্ক আর ভালো লাগছেনা। কিভাবে আগামী একুশ দিন গৃহবন্দী থাকবো এটাও আমাদের সবাইকে ভাবাচ্ছে। এই সময় ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম, মেসেঞ্জার আমাদের পরম বন্ধু হতে চলেছে। তাই চলুন এই কদিন আমরা আরো বেশি করে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হই। একটু পারস্পরিক খোঁজখবর নিই, পি.এন.পি.সি করি আর কিছুটা মজা। এই লেখাটা একটু মজা খোঁজা জন্যেই পরিবেশন করছি। অনুগ্রহ করে অপরাধ নেবেননা।
আপনারা সবাই তো আর আমার ঘরের খবর রাখেননা, তাদের জন্যে প্রাথমিক ভাবে জানাই বৈশালী হচ্ছে আমার বউ। আর বৈশালীর জামাই হচ্ছে আমাদের পিছনের বাড়ির ছেলেটি। যদিও আমাদের কোনও মেয়ে নেই, কিন্তু কিভাবে ওই ছেলেটি বৈশালীর জামাই হয়ে গেল সেটা এখন আমাদের স্মৃতিতেও আবছা হয়ে গেছে। সেজন্যে আপনারা সেই বিতর্কে যাওয়া থেকে অনুগ্রহ করে অব্যাহতি দিন।
আমরা ছোটোবেলা থেকে শিখে এসেছি - " Every dark cloud has a silver
lining". এখানেই আমাদের গল্পটা শুরুর সূত্র খুঁজে পাবে। আমি এই ফ্ল্যাটে এসেছি চোদ্দ বছর। যখন এসেছিলাম তখন আশপাশের যেসব বাচ্চাদের বয়স দশ-বারো ছিল তারা এখন রীতিমতো যুবক-যুবতী। আমার পিছনের বাড়ির ছেলেটিও তখন ওই বয়সেরই ছিল। সেই সময় বোধহয় কোনো স্কুলে পড়ত, আর বৈশালীর স্বপ্নেও ছিলোনা এই মূর্তিমানকেই একদিন জামাই হিসেবে মেনে নিতে হবে। কিন্তু সময় মানুষকে অনেক সময়ই বোকা প্রমাণিত করে মজা লোটে, এ ব্যাপারে আপনি-আমি সবাই বড় অসহায়।
যাইহোক
,সময়ের সাথে সাথে এই বাচ্চারা বড় হতে থাকলো। পিছনের বাড়ির ছেলেটি কখন স্কুল যাওয়া বন্ধ করলো খেয়াল করলামনা, যখন খেয়ালে এলো তখন সেই বাচ্চাটা একমুখ গোঁফ-দাড়ি নিয়ে নিজের ঘরে মালের আসর বসিয়ে দিয়েছে। তখন তার বাপ শ্বশুরমশাইয়ের (নামকরা জুয়েলার্স) কল্যানে নিজস্ব বাড়ি একতলা থেকে দোতলাতে উন্নীত করেছে; অর্থাৎ ছেলেকে আরো বেশি সম্পদের আশ্বাস দিয়েছে। ছেলে এর মধ্যেই অনেকটাই গোল্লায় গিয়েছে, আর বৈশালী কখন যেন একে ভালোবেসে জামাই করে ফেলেছে (যদিও কোনোভাবেই মেয়ে দিতে পারবে না৷)
গত তিন-চার বছর ধরে আমাদের সন্ধ্যা বড়ই মদ্য-মধুর; প্রত্যহ আমাদের পিছনের জানালা দিয়ে রাম-হুইস্কি-জিন-ভদকার বিবিধ গন্ধে আমরাও বেশ মাতোয়ারা হয়ে থাকতাম। কারণ আমাদের পূর্বপুরুষরা বলে গেছেন -" ঘ্রানেন অর্ধ ভোজনম", এটাকে "ঘ্রানেন অর্ধ পেয়ম" ভাবতে বেশি অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। শুধু তো তাই নয়, বেশ কয়েকজন যুবক-যুবতী মাল খেয়ে এক জায়গায় হলে কি রকম বাওয়াল করতে পারে সে ব্যাপারে আপনাদের সম্যক জানানোর কোো চেষ্টাই আমি করছি না৷ যেমন তাদের মুখের ভাষা, তেমনি চিৎকারের চোটে আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন বিপন্ন। ভাগ্যক্রমে আমার বেডরুমটা ওদের ঘরের সামনাসামনি নয়, তাই জানলা-দরজা বন্ধ করে কিছুটা অত্যাচারের হাত থেকে অব্যাহতি পাই। অবশ্যই এই অবস্থায় সব কটাকে চড়িয়ে চট্টগ্রাম পাঠিয়ে যাওয়ার জায়গায় আমি পৌঁছে গিয়েছিলাম; কিন্তু আমার গিন্নি আমাকে বারবার নিরস্ত করেছে। ও আমাকে দুটো কারণ দেখিয়েছে: এক, ওরা ওদের বাড়িতে বসে মস্তি করছে, তাই কিভাবে ওদের কনডেম করবো , আর দুই, এদের কোনো বিশ্বাস নেই- আপনি যদি এদের ম্যায়ফিলে বাধা দেন তাহলে কালকে আপনার পায়ের উপর দিয়ে বাইক চালিয়ে আপনাকে সারা জীবনের মতো খোঁড়া করে দিতে দ্বিরুক্তি করবেনা। কথাটা মানতে হলো: কারণ এদের কিছুই না থাকুক (শিক্ষা, সংস্কৃতি), বাপের দেওয়া একটা বাইক থাকবেই থাকবে। অগত্যা আমি চুপ করে থাকি।গত
পর্ব-২
এ এক আহাম্মকি চলছে তো চলছেই...!
একটা লকডাউন শেষ হয় তো আরেকটা লকডাউন শুরু !
এটা কি মাজাকি হচ্ছে ?
আমার ঘরে-বাইরে খুব খারাপ অবস্থা , আর সেই অবস্থা অর্থনীতি/গণিত শাস্ত্রের গুনক (মাল্টিপ্লায়ার) নিয়ম মেনে আমার জীবন বেশ কয়েক গুন বর্ধিত হয়ে দুর্বিষহ করে তুলছে।
প্রথম কারণটা প্রথমে বলা সমীচীন। দেশ ও দশের কল্যানে এই ক্রমবর্ধমান লকডাউন আমাকে দিয়ে আর কি কি কাজ করিয়ে নেবে ভেবে আতঙ্কিত হচ্ছি.....!!!
প্রথম সপ্তাহে এটা রান্না, বাসনমাজা আর ঘর ঝাড় দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, দ্বিতীয় সপ্তাহে এর সাথে যোগ হলো -ঘর মোছা, গাছে জল দেওয়া, আনাজ কোটা। তারপর যখন লকডাউন আরোও কয়েক সপ্তাহ বেড়ে গেলো তখন-- "তরকারিতে নুন বেশি হয়েছে, বাসনে সকড়ি লেগে আছে, সারা ঘরে ময়লা যেমন ছিল তেমনিই আছে ...” এইসব মন্তব্য। অর্থাৎ বুঝলাম আমার সমস্ত কাজ নতুন কাজের মাসি কাজ করতে এলে যে শ্যেন চক্ষুতে বিচার করা হয় সেই মাপকাঠিতে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। তার সাথে যোগ হয়েছে সকালে ঘুম থেকে উঠে করপোরেশনের বাঁশি শুনে বাড়ির যাবতীয় নোংরা সরকারি ডাব্বায় তুলে দেওয়া, পেঁয়াজ কোটা (ওনার কুটতে গেলে চোখের জল বেরোয়, ওনার ভাষ্যে -জীবনে আমার মতো একজন অর্বাচীনকে বিয়ে করে অনেক অপ্রয়োজনীয় চোখের জল ফেলতে হয়েছে এবং আগামী দিনেও অনেক ফেলতে হবে তাই পেঁয়াজ কেটে সেই অমূল্য চোখের জলের অপচয় করতে পারবেন না।), আদা বাটা, রসুন বাটা, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার দিয়ে ঘরের ময়লা টেনে নেওয়া ইত্যাদি। আর এই সপ্তাহ থেকে শুরু হয়েছে -(আগের কাজগুলো প্লাস) বেড়ালকে খেতে দেওয়া, গেটের দরজা ঠিকঠাক বন্ধ রাখা যাতে পাড়ার ঘেয়ো কুকুরেরা চত্বরের মধ্যে ঢুকতে না পারে, সবজিওলার কাছ থেকে সবজি কিনে বাইরের প্রখর রৌদ্রে দুঘন্টা শুকিয়ে, ধুয়ে-মুছে ফ্রিজে ঢোকানো। তারপর তো আছেই মাথার যন্ত্রনা, পায়ের যন্ত্রণা ইত্যাদি, সে একদম ব্যক্তিগত দাম্পত্য সমস্যা এবং সেক্ষেত্রে আমার একান্ত কর্তব্যকর্ম নাই বা আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম।
কিন্তু এত কিছুর পরও কদিন ধরে দেখছি বৈশালী খুব মনমরা। আমাকে অকারণে ঝাড় দিচ্ছেনা, কথায় কথায় এটিকেট শেখাচ্ছেনা, কোন কোন ছোটলোকের নেশা (আমার) ওকে ভদ্র জীবন যাপনে ব্যাহত করেছে সেসব উদাহরণ দিয়ে আমাকে অপদস্থ করছেনা; এমনকি আজ পাড়াতে বেচতে আসা সব্জিওলার কাছ থেকে কানা বেগুন আর পচা টম্যাটো কেনার পরও আমার উদ্দেশ্যে কোনো ধিৎকার বাণী উদ্গারিত না হতে দেখায় বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লাম। বিকেলে চা খেতে খেতে খুব রোমান্টিক স্বরে জিজ্ঞাসা করলাম, "তোমার কি শরীর খারাপ?"
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বেশ অনিচ্ছার স্বরে জবাব দিলো.....….
"
ছেলেটার কি হলো বলতো ! সন্ধ্যের ম্যায়ফিলের কথা না হয় বাদ দিলাম, ছেলেটার ঘর থেকে কোনো গানের আওয়াজও আসছেনা (লকডাউনের আগে সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত অকথ্য গান চলতো) ৷ ওর ঘরের আলো রাত নটা সাড়ে নটায় নিভে যাচ্ছে। এমনকি ঘরের জানলাটাও সবসময়ে খোলেনা। খুললেও গোটা জানালা জুড়ে হানিমুন কাপলের মতো টানা পর্দা আটকানো থাকে। এমনকি বেশ কয়েকদিন ধরে ছেলেটিকে জানলায় বসে ফুঁকতেও দেখা যায়নি।"
আমি আর কি বলবো ! নিজের কপালের সাথে ছেলেটির কপাল মিলিয়ে জীবনে এই প্রথমবার ছেলেটির জন্য কষ্ট অনুভব করলাম। ভগবানকে অশেষ ধন্যবাদ, আমাকে করুনাবশত কোনো কন্যাসন্তান উপহার দেননি। নাহলে এই অবস্থায় কি করে বসতাম কে জানে, আফটার অল ...All's well that ends well.....
পর্ব-৩
অনেকদিন পর আবার ফিরে এলাম, আসলে গত কয়েকটা মাস নির্ঘটন কেটেছে। কি আর বলবো ! বৈশালীর জামাইয়ের জন্যে আমারও অবসাদ আর বিষন্নতার কারণে মনোবিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলো। আসলে করোনা সংক্রমণের আগে আমাদের জগৎ অনেকটাই জড়িয়ে ছিল বৈশালীর (নাকি আমারও!) জামাইয়ের দৈনন্দিন খিল্লির সাথে। কাজের দিনগুলো খেয়াল করার সময় হতনা, কিন্তু ছুটির দিনগুলো শুরু হতো 'বাবাজীবনের' সাউন্ড সিস্টেমে ( তার বাবা-মায়ের আদরের উপহার) 'টুনির মা' বা ' ঝুমা চুমা দে দে'-র অমোঘ আকর্ষণে।
যাই হোক, পৃথিবী নাকি আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হচ্ছে (?); সেই স্বাভাবিকতার পথ ধরে বৈশালীর বেয়াই- বেয়ান আবার ছেলের মামাবাড়িমুখী হয়েছে , আর 'খুল যা সিম সিম' ম্যাজিকের কেরামতিতে বৈশালীর জামাইয়ের ঘরে আবার সকাল থেকে অকথ্য গান বাজছে ( মাইরি বলছি গোটা লকডাউন এবং ঘরবন্দিতে একটা গানও শুনিনি), আর দূর্গাপূজো শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৈশালীর জামাই একদম পুরোনো ফর্মে। রাত আটটার সময় চোরের মতন জানলার পাল্লা একটু খুলে দেখলাম জামাই তখনই অলমোস্ট আউট; ঘরে অন্ততঃ দশজন ছেলে কারোর মুখে মাস্ক নেই, সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিংয়ের কথা বললে হয় আপনি নয় আমি নয় দুজনেই মার খাবো ।
কিন্তু পদার্থবিদ্যা বা অর্থবিদ্যার কোনো একটা সূত্র মানলে (ঠিক মনে পড়ছেনা!) একথা বলাই যায়, একজন লেখাপড়াহীন অকর্মণ্য যুবক যখন মাল খেতে পাচ্ছে, তখন অর্থনীতি আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হচ্ছে....
সে আমার না আপনার ট্যাক্সের পয়সায় কারোর পিতৃপুরুষের দেখার দরকার নেই...৷৷
পশ্চিমবঙ্গ,কলকাতা,ভারত ।
প্রিয় পাঠক ,লেখাটি যদি আপনার ভালো লেগে থাকে ,তাহলে কমেন্ট করে জানাবেন শেয়ার করতে ভুলবেন না ।লেখা পাঠাতে পারেন আপনি । লিখতে পারেন-ভালোবাসার গল্প (Valobashar Golpo) ছোট গল্প (Choto-Golpo) ভালবাসার গল্প (Balobashar Golpo) হাসির গল্প।(Hashir Golpo) জীবনের গল্প (Jiboner Golpo) প্রেমের গল্প (Premer Golpo) । সহ সাহিত্য বিষায়ক যেকোন লেখা । মেইল করুন- chailipimagazine@gmail.com
0 মন্তব্যসমূহ