প্রতিদিনের মত সন্ধ্যা নামতেই ওরা ক্লাবে তাস ,দাবা খেলা নিয়ে মেতে উঠলো। ওরা মানে গোবিন্দ , কার্তিক, সুবল ,মহেশ আর আমি মানে সাধন । সেই ছোটবেলা থেকে বন্ধুত্ব আমাদের , তখনই নিজেরাই উদ্যেগ নিয়ে একটা ক্লাব তৈরী করেছিলাম নাম দিয়েছিলাম নবীন সংঘ। আসতে আসতে সেই নবীন সংঘ কখন যে প্রবীণ সংঘ হয়ে গেছে তা নিজেরাই টের পায়নি । আমাদের বয়স কারুরই ৬০ এর কম না। কিন্তু এত বয়স হয়ে গেলেও পরিবারের আপত্তি সত্ত্বেও সন্ধ্যা নামলেই আমাদের ক্লাবে আসা চাই চাই নইলে আমাদের মনটা আকুপাকু করে। আগে এই ক্লাবে আরো অনেক সদস্য ছিল ,কিন্তু কমতে কমতে সদস্য পাঁচে এসে থেকেছে। আমরাই ক্লাবের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রেখেছি। বর্ষা হোক কি শীত প্রত্যেকের ক্লাবে হাজিরা চাই চাই , এদের মধ্যে কার্তিকের উৎসাহ অবশ্য সবচেয়ে বেশি।
সেদিন সকাল থেকেই হচ্ছিল প্রচন্ড বৃষ্টি। অবশ্য বর্ষাকালে বৃষ্টি না হওয়াটা শরৎকালে দুর্গাপূজা না হওয়ার মতোই। তবু বিকেলের দিকে বৃষ্টি একটু ধরতেই সবাই ক্লাবে চলে এসেছিল।আসেনি শুধু কার্তিক। সবাই বেশ চিন্তিত কার্তিক কোনোদিনও ক্লাবে আসেনা এমনটা হয়নি। এই ক্লাবের ব্যাপারে ওর উৎসাহই সবচেয়ে বেশি সেই প্রথম থেকে। তবে কি শরীর টরীর খারাপ হল নাকি। মহেশ বলল “সাধন তোর বাড়ি তো কার্তিকের বাড়ির দিকেই , কার্তিকের খবর কিছু শুনেছিস নাকি ?” আমি বললাম “না রে ,আজ সকালে বাজার যাওয়ার পথে ওর সাথে দেখা হয়েছিল, বরং ও নিজেই বলল আজ ক্লাবে যাবি তো ? হয়তো বৃষ্টির জন্য মাঝপথে কোথাও আটকে গেছে। একটু পরেই চলে আসবে।”
সবাই কার্তিকের কথা ভাবতে ভাবতে তাস পিটোতে শুরু করলো। বাইরে বৃষ্টিটা আবার ব্যাপক ভাবে শুরু হয়েছে। আজকে বৃষ্টির জন্য রঘুও দোকানটা খোলেনি। অবশ্য চা ছাড়া আড্ডাটা ঠিক জমে না। কিন্তু কি করা যাবে ,যস্মিন দেশে যদাচার। আমাদের খেলা তখন মধ্যগগনে এমন সময় ক্লাবের দরজা ঠেলে কার্তিকের প্রবেশ। প্রায় কাকভিজে হয়ে ঢুকেছে সে। ওকে দেখতে পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি আর সুবিমল। সুবল বলল “কিরে , এত দেরি , তোর ছেলে আসতে দিচ্ছিল না নাকি ?”. মহেশ বলল “তুই তো কাকভিজা ভিজে গেছিস। আজকের দিনটা না এলেই ভালো করতিস , ঠান্ডা লাগিয়ে এই বুড়ো বয়সে কিছু একটা বাধিয়ে দিলে তোর ছেলেই আবার আমাদের কথা শোনাবে।” কার্তিক ছাতাটা দরজার সামনে রেখে আমার হাত থেকে গামছাটা নিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বলল “আর বলিস না ,বেরোতে যাবো সে কি বৃষ্টি। তোরা তো জানিসই একদিন ক্লাবে না এলে আমার আবার ভাত হজম হয় না। তাই অগত্যা একটু বৃষ্টি ধরতেই ছাতাটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু মাঝপথে আবার সে কি বৃষ্টি। ভাবলাম দাঁড়িয়ে পড়বো ,কিন্তু কোথাও ঠাঁই পেলাম না। তাই ছাতা নিয়ে হাটতে লাগলাম। কিন্তু ছাতা কি আর বাঁধ মানে। তাই আর কি ভিজেই চলে এলাম। না চল সাধন একদান দাবা হবে নাকি।” আমাদের মধ্যে আমার আর কার্তিকের মধ্যে দাবা বেশ জমে ভালো। এক আধদিন তো খেলতে খেলতে কখন বিকেল গড়িয়ে রাত হয়ে যায় টেরই পাই না। কার্তিক গা ভালো করে মুছে দাবার বোর্ড নিয়ে বসে পড়ল। আমিও বসে পড়লাম খেলতে। কিন্তু আজ অন্যান দিনের তুলনায় কার্তিককে কেমন অস্বাভাবিক লাগছে। ওর যেন খেলায় মন নেই। মনের মধ্যে যেন তাড়াহুড়ো ভাব। বারবার চাল ভুল দিচ্ছে। তাই কিছুক্ষুনের মধ্যেই ওকে কিস্তিমাত করে দিলাম। আমি বললাম “কি কার্তিক আজ তোর রাজার কি যুদ্ধে মন নেই নাকি। আরেকদান হোক নাকি ?” কার্তিক বলল “না রে উঠি। আজ আর খেলায় মন বসাতে পারছি না। বাড়ি যাই। “ ওর কথা শুনে তাস পিটতে পিটতে গোবিন্দ বলল “কেন রে শরীর খারাপ করছে নাকি। একে এই বৃষ্টিতে ভিজে এসেছিস। এখনো বেশ ভালোই বৃষ্টি হচ্ছে। এখন গেলে নির্ঘাত ভিজে নিউমোনিয়া বাধাবি। তার থেকে আরেকদান খেলে ফেল ,বৃষ্টি কমলে আমরাও বেরিয়ে পড়বো। আমাদের সাথেই না হোক বেরিয়ে পড়িস। কিন্তু কিছু ভাবেই ওকে আটকে রাখতে পারলাম না আমরা। কিসের তাড়া এত কে জানে। আমরাও আর তাই ওকে জোর করলাম না। প্রায় হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে পড়লো। এতটাই তাড়া ওর যে ছাতাটা নিতেও ভুলে গেল অবশ্য তখন সেটা আমরা নিজেরাও খেয়াল করিনি। কার্তিক চলে যেতেই সুবল বলল “কার্তিকের আজ এত তাড়া কিসের বুঝলাম না বাপু। এতো তাড়া থাকলে না আসলেই পারতো। খামোকা বৃষ্টিতে ভিজে কিছু একটা বাধাবে। “ তারপর আর আমাদের খেলা সেরম জমলো না। সবাই কার্তিকের খামখেয়ালিপনা নিয়ে বলাবলি করতে লাগলো। এমন সময় ক্লাবের দরজা ঠেলে ঢুকলো তিনজন ছোকরা। যার মধ্যে একজনকে আমরা বেশ ভালো ভাবেই চিনি। সে হল কার্তিকের নাতি সরোজ। বাকি দুজন হয়তো তার বন্ধু। তিনজনই বেশ হাফাচ্ছে। চুল বেয়ে জল টপটপ করে পড়ছে। ওকে দেখতে পেয়ে আমি বললাম “তোর দাদু তো একটু আগেই বাড়ির দিকে গেল। আজ তোদের বাড়িতে কিছু আছে নাকি। ?“ আমার কথা শেষ করতে না দিয়েই মহেশ বলল “তোমরা কি বলছো, দাদু এখানে আসবে কি করে। বাবার আপত্তি সত্ত্বেও দাদু ছাতা মাথায় বেরিয়েছিল ক্লাবের দিকে। বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট এমনি পিছল থাকে। তাই আসার পথে ওপারে যে গোপালদের পুকুরটা আছে ওখানে দাদু হুমড়ি খেয়ে পরে গেছিল। ভরা বর্ষায় পুকুরের জল এমনি উপছে পড়ছে। তাই সাঁতার জানলেও এই বয়সে তা আর কাজে আসেনি। পুকুরে একটা আওয়াজ শুনে আমার বন্ধু শুভ বেরিয়ে দেখে। দাদু পাড়ে ওঠার জন্য আকুপাকু করছে। শুভ সাঁতরে দাদুকে পাড়ে নিয়ে এলেও আর বাঁচানো যায়নি। দাদু আর আমাদের মধ্যে নেই.” বলেই সজোরে কেঁদে উঠলো সরোজ। আমাদের মাথায় কিছুই ঢুকলো না। যে লোকটা কিছুক্ষুণ আগে আমার সাথে দাবা খেলল সে পুকুরে ডুবে মারা গেছে, এ যেন বিশ্বাসযোগ্য লাগলো না। কিন্তু ওর নাতি বানিয়ে বলবে তেমনটাও নয়। আমরা প্রত্যেকে নিজেদের মুখ চাওয়াচায়ি করতে লাগলাম। অবশেষে ঠিক করলাম ওদের সাথে যাবো কার্তিকের বাড়ি। তখনও জানতাম না আমাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে।
কার্তিকের বাড়ির কাছাকাছি যেতেই অনেক লোকের কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম। কার্তিকের বাড়ির সামনে উঠোনে কার্তিকের নিথর দেহটা শুয়ে আছে। যে লোকটা কিছুক্ষুণ আগে আমার সাথে দাবা খেলল তার এরম পরিণতি আমরা কিছুতেই মানতে পারলাম না। ওকে ঘিরে ওর বাড়ির লোক বসে আছে। প্রত্যেকের মধ্যে বিলাপের ভাব স্পষ্ট। আমাদেরও চোখে জলের বাঁধ মানলো না। সেই কোনো ছোটবেলার বন্ধু আমাদের। এরম অকস্মাৎ মৃত্যু হবে ভাবতেই পারিনি। যাইহোক কিছুক্ষুণ বাদে ওর নিথর শরীরটা নিয়ে চললাম শ্মশান ঘাটের দিকে। ওর ছেলে সহ পাড়ার কয়েকজন ছেলে ছোকরা মিলে ওকে কাঁধ দিল। আমরা চললাম পিছু পিছু। শ্মশানে গিয়ে দাহকার্য সম্পন্ন হবার পর আমাদের কারুরই মনের অবস্থা ভালো নেই। তাই আমরা চার বন্ধু ঠিক করলাম আজ আর কেউ বাড়ি যাবো না, ওর যখন সবথেকে প্রিয় জায়গা ছিল নবীন সংঘ ওখানেই আমরা চারবন্ধু রাত কাটিয়ে ওর স্মৃতিচারণ করবো। তাছাড়া আমাদের মন এতটাই ভারাক্রান্ত আমাদের বাড়ি যেতে মন হল না।
আমরা ওর ছেলেকে মন শক্ত করার পরামর্শ দিয়ে হাটতে লাগলাম ক্লাবের উদ্যেশে। এখন বৃষ্টি না কমলেও ফোটা ফোটা পড়ছে। কোনোরকমে একটু জোরে পা চালিয়ে ক্লাবের সামনে চলে এলাম। তাড়াহুড়োর জন্য ক্লাবের দরজা কোনোরকমে ভেজিয়ে চলে এসেছি। মহেশ প্রথম দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে গেল। কিন্তু দরজা খুলতেই আমাদের গা শিউরে উঠলো। আমাদের ক্লাবে রাখা চেয়ারটায় বসে আছে কার্তিক। আমাদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে হেসে বলল "কিরে আমায় দেখে ভয় পেয়ে গেলি বুঝি। ভাবছিস যাকে তোরা দাহকর্য করে এলি সে কি করে এখানে এল। হ্যা আমি সত্যি এখন ইহলোকে নেই। আসলে ক্লাবে না আসলে মনটা কেমন করে। তাই সকলের কথা না শুনেই আসছিলাম। কিন্তু বাধ সাধলো বৃষ্টি। আসার পথে পা হড়কে পড়ে গেলাম পুকুরে। তোরা জানিস এককালে বেশ ভালোই সাঁতার কাটতাম। কিন্তু এখন বুড়ো বয়সে আর ভরা বর্ষায় পেরে উঠলাম না। শরীর ছেড়ে দিল। বুঝলাম আজই আমার শেষ দিন। কিন্তু মন কি আর ক্লাবে না এলে মানে। তাই আর কি তখন ক্লাবে হাজিরা দিয়ে গেলাম।" একটু থেমে কার্তিক আবার বলল "চিন্তা করিস না আমি এবার থেকে প্রতিদিনই আমি ক্লাবে আসবো। শরীরটা চলে গেছে কিন্তু মনটা এই ক্লাবেই রয়ে গেছে। আর হ্যা কাল আবার আসবো ক্লাবে, সাধনের সাথে আজকে হারার শোধটা নিতে হবে যে"
ঠিকানা :- ১০১,বেদিয়াপাড়া লেন ,কলকাতা ৭৭
0 মন্তব্যসমূহ